মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তিতে ভ্রমণ শেষে ওয়েবসাইটে সে সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লিখেছেন এক পর্যটক। “দারুণ একটা দিন কাটালাম। ওখানে সবাই খুব বন্ধু ভাবাপন্ন। কেউ ভিক্ষা চাইছিলও না।” ভারতের বস্তির সরু অলিগলি দেখতে আগ্রহী হাজার হাজার পর্যটকদের মধ্যে তিনি একজন মাত্র। এর নাম দেয়া হয়েছে “বস্তি পর্যটন” বা “দারিদ্র পর্যটন”।
যেভাবে এর শুরু-
ভারতে এই বিতর্কিত পর্যটন ব্যবসায় বেশ ভাল অর্থ উপার্জন হচ্ছে। পর্যটকেরা ভারতের তাদের অবকাশ যাপনের অংশ হিসেবে খুব কাছে থেকে দারিদ্র এবং দরিদ্র মানুষের জীবন দেখতে যাচ্ছেন।
আপনি হয়ত ভাববেন ভারতে বেড়াতে গেলে বেশিরভাগ মানুষ তাদের সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য হিসেবে বিখ্যাত তাজমহলের কথাই বলবে। কিন্তু ধারাভি বস্তির অভিজ্ঞতা এখন সবচাইতে জনপ্রিয় পর্যটন অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রচার পাচ্ছে। জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ওয়েবসাইট ট্রিপঅ্যাডভাইজারে এটি পর্যটকের সবচেয়ে পছন্দের তালিকায় পুরস্কারও পেয়েছে।
কৃষ্ণা পূজারী ২০০৫ সালে “রিয়ালিটি টুরস অ্যান্ড ট্রাভেল নামে একটি কোম্পানি খুলেছিলেন। এই কোম্পানিই ভারতে এমন বিতর্কিত পর্যটনের প্রবর্তনের সাথে জড়িত।
কৃষ্ণা পূজারী বলছেন, “বস্তির অভিজ্ঞতা নিতে আসা বেশিরভাগ পর্যটক আসেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর অস্ট্রেলিয়া থেকে।” তিনি বলছেন, “যখন আমার কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা, এক ব্রিটিশ বন্ধু ক্রাইস্ট ওয়ে এরকম একটা টুর চালু করার কথা বললেন আমি খুব বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বস্তি দেখতে চাইবে কেন কেউ? তারপর আমি বুঝলাম আসলে সেখানে অনেক কিছু দেখার এবং শেখার আছে।”
ধারাভি বস্তির মানুষের কথা-
ধারাভির অবস্থান মুম্বাই শহরের একেবারে কেন্দ্রে। আনুমানিক দশ লাখ লোকের বাস সেখানে। আর সব বস্তির মতো সরু গলি, অন্ধকার খুপরি ঘর, খোলা নোংরা ড্রেন আর দুর্গন্ধযুক্ত টয়লেট সেখানকার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
অধিবাসীদের অনেকেই চামড়া সামগ্রী তৈরির ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। যেগুলো উন্নত রপ্তানি সামগ্রী। এছাড়া এমব্রয়ডারির ফ্যাক্টরি, প্লাস্টিক সামগ্রী উৎপাদন আর মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িত অনেকে।
এখানে যে ব্যবসা হয় তা আনুমানিক হিসেবে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো। তবে সেখানে আরও থাকেন গাড়ি চালক, দিন মজুর থেকে শুরু করে আরও নানা পেশার মানুষ। মুম্বাই শহরের চাকা এক অর্থে এই বস্তির মানুষেরাই টিকিয়ে রেখেছেন।
বস্তি নিয়ে পর্যটকদের কেন এত আগ্রহ?
মেলিসা নিসবেট ২০১৬ সালে ধারাভিতে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ছয় ঘণ্টা ধরে ঘুরেছেন বস্তির আনাচে কানাচে।
তিনি বলছেন, “আসলে আমরা সেই ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকে বস্তি ঘুরে দেখছি। শুরুতে বিষয়টা ছিলও পুরোটাই বিনোদনের জন্য। কিন্তু তারপর সেটি সামাজিক সংস্কারের সাথে মিশে গেছে।” বস্তিতে খাওয়ার অভিজ্ঞতাও পেতে পারেন আপনি। সেরকম অভিজ্ঞতা দেবার জন্যে পর্যটন কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে।
সেটিকে তারা নাম দিয়েছেন “সাংস্কৃতিক আদান প্রদান”। “ইনসাইড মুম্বাই” সেরকম একটি কোম্পানি। তবে পশ্চিমারা যে এই প্রথম দারিদ্র দেখতে ভ্রমণে যাচ্ছেন তা নয়।
এর আগে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার বস্তিতে এমন পর্যটন চালু হয়েছে।
মেলিসা নিসবেট বলছেন, “আমি যে কারণে গিয়েছিলাম আমার মনে অন্য পর্যটকেরাও একই কারণে সেখানে গিয়েছেন। সেটা হল জীবনের বাস্তবতা অনুধাবন করতে চাওয়া।” তিনি সেখানে যা দেখেছেন তাতে উদ্বিগ্ন হয়েছেন বলে জানালেন।
দারিদ্র নিয়ে ‘রোমান্টিসিজম’?
মেলিসা বলছেন, “এক্ষেত্রে এমনভাবে বস্তিকে তুলে ধরা হয়েছে যে সেখানে গেলে কোন ঝামেলা হবে না। দারিদ্রকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যেন এটাই স্বাভাবিক বাস্তবতা। বরং দারিদ্রকে রোমান্টিসাইজ করা হয়েছে।” তিনি বলছেন, এসব ভ্রমণে সরাসরি বস্তিবাসীদের সাথে কথাবার্তা বলা নিরুৎসাহিত করা হয় তাই তাদের অনুভূতি বোঝা মুশকিল।
সেখানকার অধিবাসীরাও বিদেশী এসব পর্যটকদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিজেদের দৈনন্দিন জীবন চালিয়ে যেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। মেলিসা ওয়েবসাইটে হাজার হাজার বস্তি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পরেছেন। যেগুলোকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বেশ ধাক্কাই খেয়েছেন।
তিনি দেখতে পেয়েছেন বেশিরভাগ পর্যটক সেখানে যাচ্ছেন দারিদ্র সম্পর্কে উদ্বেগ নিয়ে। কিন্তু সেখানে সময় কাটিয়ে ফিরছেন এমন মনোভাব নিয়ে যেন সেখানে কোন সমস্যাই নেই।
বস্তির কর্ম উদ্দীপনাকে সামনে তুলে আনার চেষ্টা?
কৃষ্ণা পূজারী বলছেন, তারা শুধু দারিদ্রই তুলে ধরছেন না। টিকে থাকার জন্য বস্তির মানুষের যে কর্ম উদ্দীপনা সেটিও তারা দেখাতে চান।
তিনি বলছেন, “আমরা পুরো বাস্তবতা তুলে ধরি। ঝুলে থাকা পেঁচানো বিদ্যুতের তার থেকে শুরু করে ময়লার ব্যবসা সব আলাপ করি আমরা। বস্তি মানেই যে শুধু দারিদ্র, ভিক্ষা আর অপরাধ সেই ধারনা আমরা বদলাতে চাই।”
বস্তির অধিবাসীরা যাতে অস্বস্তি বোধ না করেন তাই তার কোম্পানি সেখানে পর্যটকদের ছবি তুলতে দেন না। লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফেবিয়ান ফ্রেনযেল বলছেন, “এধরনের ভ্রমণ হয়ত দারিদ্র ও বস্তির মানুষের জটিল সমস্যাগুলোর দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ পেতে সাহায্য করবে।”
এর হয়ত ইতিবাচক প্রভাব কিছু পড়বে বলে তিনি মনে করেন। পর্যটকদের কারণে বস্তি উচ্ছেদ হওয়ার আশংকায় হয়ত কমবে।
ফেবিয়ান ফ্রেনযেল বলছেন, “ভারত যেমন চাঁদে রকেট পাঠাচ্ছে কিন্তু আবার একই সাথে সেখানে বিশাল জনগোষ্ঠী চরম দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। ভারতের রাজনীতি কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেয় এবং তার ফলে যে অবিচারের জন্ম হয়, এমন পর্যটন হয়ত সেটির দিকে কিছুটা দৃষ্টিপাত করবে।”
সূত্র: বিবিসি বাংলা
 
					 
                             
                             
                             
                            