অমানবিক নির্যাতনের শিকার গৃহপরিচারিকা সাবিনা : খুমেকে ভর্তি

প্রকাশঃ ২০১৮-০৫-১৯ - ২১:২৪

চিকিৎসা না হওয়ায় এক হাত পঙ্গুত্বের আশঙ্কা

কামরুল হোসেন মনি : সাবিনা খাতুন (২৫)। সংসারের অভাব মেটাতে কাজের জন্য ঢাকার ধানমন্ডি ৯নং রোডের ১৭নং বাড়িতে সিদ্দিকুর রহমান টুটুলের বাসায় গত এক বছর ধরে গৃহপরিচারিকার কাজ নেন। গত দুই মাস আগে কারণে-অকারণে গৃহকর্ত্রী তাকে ব্যাট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতন চালাতো। নির্যাতনে তার বাম ও ডান হাত এবং পায়ের বিভিন্ন স্থানে হাড়ের জয়েন্ট ভেঙে যায়। এমনকি মাথায় ছুরি দিয়েও আঘাত করা হয়। ওই অবস্থায় দেওয়া হয়নি তাকে কোন ধরনের চিকিৎসা পর্যন্ত। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগ ১ ও ২নং ওয়ার্ডের ৭নং বেডে গৃহপরিচারিকা ভর্তি রয়েছেন। বুধবার (১৬ মে) বিকেলে তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
খুমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ও কলেজের উপাধ্যক্ষ ডাঃ মেহেদী নেওয়াজ এ প্রতিবেদক বলেন, ওই গৃহপরিচারিকা সাবিনার ভাষ্য অনুযায়ী যেখানে সে কাজ করতো সেখানকার গৃহকর্ত্রী তাকে অমানবিক নির্যাতন চালাতো। নির্যাতনে পর তাকে চিকিৎসা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। নির্যাতনের কারণে হাত-পা ভাঙার পরও চিকিৎসা না দেওয়ায় জটিল ফ্রাকচার হয়েছে। শুরু থেকেই চিকিৎসা পেলে এ অবস্থা হতো না। তার একটি হাত পুরোপুরি ঠিক না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই হাত দিয়ে সে আর কোনদিন ভারি জিনিস তুলতে পারবে না।
বৃহস্পতিবার (১৭ মে) খুমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গৃহপরিচারিকা সাবিনা জানান, দুই ছেলে মেয়ে ও স্বামীর অল্প আয়ের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সংসারের অভাব মেটাতে গত এক বছর আগে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয় মমতাজ তাকে ঢাকায় কাজের জন্য নিয়ে আসেন। ঢাকার ধানমন্ডি ৯নং রোডে ১৭নং ফ্ল্যাটে সিদ্দিকুর রহমান টুটুলের বাসায় মাসিক ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে কাজে যোগ দেয় সে। চুক্তি অনুযায়ী তাকে ৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হতো। কয়েক মাস ভালোভাবে কাটার পর টুটুলের স্ত্রী নূরজাহান কারণে-অকারনে মারধর শুরু করেন। গত দুই মাস আগে এই নির্যাতনের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলে। তার মাথায় নূরজাহান ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে। ছুরির আঘাতে মাথা ফেড়ে গেলেও তাকে চিকিৎসা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ব্যাট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতন চালাতো। হাত ভেঙে যায়, তার পরেও তাকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে ঘরের মধ্যে আটকিয়ে রাখা হতো। দুই-একটা ব্যথার ট্যাবলেট ছাড়া কিছুই দেওয়া হয়নি। এমন অবস্থায় সাবিনা দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার মোবাইল পর্যন্ত আটকিয়ে রাখে, যাতে এই নির্যাতনের কথা কাউকে বলতে না পারি। সাবিনা বলেন, আমার মতো কোন গৃহপরিচারিকা যেন এভাবে আর নির্যাতনের শিকার না হন।
সাবিনার বড় বোন হাফিজা খাতুন বলেন, তার মা মমতাজ গত শনিবার ঢাকা থেকে সাবিনাকে নিয়ে আসেন। ওই দিন তার বোনকে মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার সময় সাদা কাগজে সাক্ষর করিয়ে রাখেন। তিনি বলেন, তার বোন মোবাইলফোনে বাসায় আমাদের জানাবে তারও উপায় ছিলোনা। তার মোবাইলফোনটি আটকিয়ে রাখে। আসার সময় ওই মোবাইলফোনটি ফেরত দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার কো-অর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, গৃহপরিচারিকা নির্যাতন আইনের পরিপন্থী। ঢাকায় যে পরিবারে ওই গৃহপরিচারিকাকে নির্যাতন করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নির্যাতনের শিকার গৃহপরিচারিকা সাবিনাকে তাদের সংস্থার পক্ষ থেকে মামলার যাবতীয় খরচ বহন করা হবে। আর দোষীরা যাতে আইনের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় সে ব্যবস্থা করা হবে।
জানা গেছে, শুধু সাবিনার মতো গৃহপরিচারিকারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না। তার মতো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই অসংখ্য গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। দিনের পর দিন আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। কেউ পালিয়ে গেলে তাকে চুরির অভিযোগ দিয়ে ধরে আনা হচ্ছে। অভিযুক্তরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন গৃহস্থালির গৃহকর্মীরা প্রতিনিয়ত এক শ্রেণির পাষ- গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর নির্দয় আচরণের শিকার হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট কোন অপরাধ ছাড়াই তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। প্রচলিত আইন ও বিধি বিধান প্রয়োগও থামাতে পারছে না গৃহকর্মী নির্যাতনের অপরাধ।