আবরার হত্যা : অমিত সাহা নাটকের অবসান কি ঘটলো?

প্রকাশঃ ২০১৯-১০-১০ - ১৬:২০
ঢাকা অফিস :  হত্যা মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হলেও, সেই তালিকায় ছিলো না অমিত সাহার নাম।  ধুম্রজাল অনেকটাই কেটে গিয়ে অবশেষে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার হলেন বুয়েট ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহা। বৃহস্পতিবার সকালে, রাজধানীর সবুজবাগ কালীবাড়ি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপি’র গোয়েন্দা ও অপরাধতথ্য বিভাগ। যেখানে, এই হত্যা মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হলেও, সেই তালিকায় ছিলো না অমিত সাহার নাম। যদিও শুরু থেকেই আবরার হত্যায় অমিত সাহার নাম এসেছিলো। অমিত সাহা বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র।

এর আগে, অমিত সাহাকে নিয়ে সৃষ্টি হয় ধুম্রজাল। তাকে কেন হত্যাকাণ্ডের মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়েছিলো, এনিয়ে চলে নানান জল্পনা কল্পনা। অমিত সাহার নাম আসামির তালিকায় না থাকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা সমালোচনা হয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ্।

পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ-ডিবির (ঢাকা দক্ষিণ) এডিসি রাজীব আল মাসুদ মঙ্গলবার বলেছিলেন, ‘বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র অমিত সাহাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়নি। তদন্ত সাপেক্ষে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

শেরে বাংলা হলের ২০১১ নং রুমে থাকতো অমিত সাহা, যে রুমে আবরারকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। এছাড়া, সেই কক্ষে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবা বিষয়ক উপসম্পাদক ও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ।

বুয়েটের টর্চার সেল খ্যাত শেরে বাংলা হলের ২১১ কক্ষে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই অমিতের ব্যাপারে বক্তব্য রেখেছেন। ওই রুমে থাকা একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেছেন, ‘অমিত একটু দেরি করে ফোন পেয়েই আসেন। তিনি এসে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেছেন আবরারকে। বলেছেন তার লেখালেখির বিষয়ে অনেক কথা। এক পর্যায়ে তিনি স্ট্যাম্প নিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছেন।’

বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু বলেন, ‘আবরারকে শিবির সন্দেহে রাত ৮টার দিকে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে আনা হয়। সেখানে আমরা তার মোবাইলে ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জার চেক করি। ফেসবুকে বিতর্কিত কিছু পেজে তার লাইক দেওয়ার প্রমাণ পাই। সে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন অমিত সাহা। পরে চতুর্থ বর্ষের ভাইদের খবর দেওয়া হয়। খবর পেয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার সেখানে আসেন। একপর্যায়ে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি। এরপর হয়তো ওরা মারধর করে থাকতে পারে।  পরে, রাত তিনটার দিকে শুনি আবরার মারা গেছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবরারের একাধিক সহপাঠি অভিযোগ করে বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমিত সাহা সরাসরি সম্পৃক্ত। তিনি একজন বড় বড় কর্মকর্তার আত্নীয়।’

এর আগে, ফেসবুক ও কয়েকটি অনলাইন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের আগে ১৭তম ব্যাচের (আবরারের সহপাঠী) এক শিক্ষার্থীকে অমিত সাহা ম্যাসেঞ্জারে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আবরার ফাহাদ কি হলে আছে?’ এ ধরনের একটি স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ১৭তম ব্যাচের ওই শিক্ষার্থী নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে না চাওয়ায় তারই এক সিনিয়র বিষয়টি ফেসবুকে প্রকাশ করেন।

অপরদিকে, অমিত সাহাকে সমর্থন দিয়ে তার বন্ধুরা প্রথমে তার পক্ষ নিলেও, পরে নতুন স্ক্রিনশটটি আসার পর তারাও সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তারা লেখেন, ‘আমরা জানি, এ রকম ঘটনায় একদম ধোয়া তুলসি পাতা কেউ হঠাৎ করে জড়ানো সম্ভব না। অবশ্যই তার একাধিক ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে, যা আমরা গুরুত্ব সহকারে কখনো নেইনি বা দেখেও ওভারলুক করেছি। আমাদের এই অসচেতনতার জন্যই আজ এদের মতো অপরাধীর জন্ম।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, বুয়েটের শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থী, সিসিটিভি ফুটেজ ও আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে।

সূত্র জানায়, আবরারকে পেটানোর সময় ওই কক্ষে অমিত সাহা, মুজতাবা রাফিদ, সকালসহ তৃতীয় বর্ষের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই কক্ষে এসে দ্বিতীয় দফায় ফাহাদকে পেটান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক ও নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একই বর্ষের মেফতাহুল ইসলাম জিয়নসহ কয়েকজন।

মামলায় আসামি যে ছাত্রলীগ নেতারা:

আবরার হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি করা হয়েছে মেহেদী হাসান রাসেলকে (২৪)। তিনি ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক। তার বাবার নাম রুহুল আমিন, গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের সালথা থানাধীন সূর্যদিয়া রাংগারদিয়ায়।

দুই নম্বর আ’সামি করা হয়েছে মুহতাসিম ফুয়াদকে (২৩)। তিনি ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সহ-সভাপতি। তার বাবার নাম আবু তাহের। গ্রামের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়ার দৌলতপুর লাঙ্গলমোড়ায়। শেরেবাংলা হলের ২০১০ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী।

মামলার তিন নম্বর আসামি অনিক সরকার (২২)। ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। তার বাবার নাম আনোয়ার হোসেন। গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর মোহনপুর থানাধীন বড়ইকুড়িতে। একই হলের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

চার নম্বর আসামি ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (২২)। তার বাবার নাম মাকসুদ আলী। গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর পবা থানার চৌমহানীর কাপাসিয়ায়। শেরেবাংলা হলের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

পাঁচ নম্বর আসামি ইফতি মোশারফ সকাল (২১)। ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার উপ সমাজসেবা সম্পাদক। বাবার নাম ফকির মোশারফ হোসেন। স্থায়ী ঠিকানা রাজবাড়ী সদরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৯৫ নম্বর বাসা। একই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষের ও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচ।

মামলার ছয় নম্বর আ’সামি মনিরুজ্জামান মনির (২১)। ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সাহিত্য সম্পাদক। বাবার নাম মাহতাব আলী। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ থা’নাধীন ভাঙ্গারীপাড়ায়। একই হলের পানি সম্পদ বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

সাত নম্বর আসামি মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (২২)। ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার ক্রীড়া সম্পাদক। বাবার নাম শহিদুল ইস’লাম। গ্রামের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর থানার শঠিবাড়ী এলাকায়। একই হলের মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

আট নম্বর আসামি হলো মাজেদুল ইস’লাম (২১)। সাংগঠনিক পরিচয় ও ঠিকানাও অজ্ঞাত। শেরেবাংলা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও ম্যাটেরিয়াল অ্যান্ড ম্যাটার্লজিক্যাল বিভাগের ১৭তম ব্যাচ।

৯ নম্বর আসামি মোজাহিদুল ওরফে মোজাহিদুর রহমান (২১)। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সদস্য। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ৩০৩ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী ও ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচ।

১০ নম্বর আসামি হলো তানভীর আহম্মেদ (২১)। সাংগঠনিক পরিচয় ও ঠিকানা অজ্ঞাত। একই হলের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

১১ নম্বর আসামি হলো হোসেন মোহাম্ম’দ তোহা (২০)। সাংগঠনিক পরিচয় ও ঠিকানা অজ্ঞাত। একই হলের ২১১ নম্বর কক্ষের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

১২ নম্বর আসামি জিসান (২১)। সাংগঠনিক পরিচয় ও ঠিকানা অজ্ঞাত। একই হলের ৩০৩ নম্বর কক্ষের ছাত্র ও ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

উল্লেখ্য, গত ৬ই অক্টোবর দিবাগত মধ্যরাতে বুয়েটের সাধারণ ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবরার ফাহাদকে শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সোমবার (৭ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে সোমবার সন্ধ্যার পর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ্। এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ এখন পর্যন্ত মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।