ইটভাটায় নিয়োজিত শ্রমিকরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে : আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই

প্রকাশঃ ২০১৯-০৪-২৮ - ১৫:০২

কামরুল হোসেন মনি : কোনো ধরনের অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসা করায় না, টাকা পয়সাও দেয় না। নিজের খরচে চিকিৎসা করাতে হয়। টাকা চাইলে দিবে অগ্রিম দাদন হিসেবে। পরে মজুরি থেকে কর্তন করে নেয় মহাজনরা। অসুখের মধ্যে কাজে না আসলে মজুরি হয় না। এমনভাবেই কথা তুলে ধরেন ইটভাটার শ্রমিক মোঃ শীমাম হোসেন।
চিকিৎসকদের মতে, ইটভাটায় শ্রমিকরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে বেশি থাকে। অধিকাংশ ভাটায় ধোঁয়া রোধক মাস্ক (মুখোশ) ছাড়া কাজ করেন শ্রমিকরা। তাদের শরীরে ধূলাবালি অবাধে প্রবেশ করার সুযোগ পেলেও, তার প্রতিরোধে শ্রমিকদের অসচেতনতার পাশাপাশি, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে মালিক পক্ষের রয়েছে উদাসীনতা।
খুলনার ইটভাটায় নিয়োজিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে আজ ২৮ এপ্রিল জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস পালিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে খুলনা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আয়োজনে বর্ণাঢ্য র‌্যালি, আলোচনা সভা ও দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
শনিবার রূপসা উপজেলা ২নং শ্রীফলতলা ইউনিয়নে হিরো ব্রিক্স ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিক শামীম হোসেনের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, মহাজনরা দাদন দিয়ে রাখেন। বছরের ৫-৬ মাস ইটভাটায় কাজ হয়। বাকী সময় অন্য কাজে জড়িয়ে পড়েন। দাদন হিসেবে কাজে গেলে দিনে ১ হাজার ইটে ৪৫ টাকা দেন। বাকী টাকা দাদনের থেকে কর্তন করেন। ইটভাটায় চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকাই দিতে চায় না আবার চিকিৎসা। হিরো ব্রিক্স এর ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, পারুল বেগম নামে এক মহিলা শ্রমিক কাঁচা ইটগুলো রোদে শুকানোর জন্য সারিবদ্ধভাবে সাজাচ্ছেন। ধূলাবালি রোধক মাস্ক (মুখোশ) ছাড়া কাজ করছেন তিনি। তার স্বামী মোঃ আঃ লতিফও এই ভাটায় কাজ করেন। চিকিৎসার খরচ বা ব্যবস্থা আছে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি চুপ হয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে বলেন, আমি কিছু বলবো না, যদি কোনো ক্ষতি হয়। এই ইটভাটার মধ্যে শ্রমিকদের থাকার জন্য ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর রয়েছে। কোনো বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা নেই। কোনোমতে শ্রমিকরা দিনযাপন করে কাজে যোগ দিলেই হলো এমনই মানসিকতা মহাজন ও মালিকদের মধ্যে। রূপসা উপজেলায় গড়ে ওঠা অধিকাংশই ইটভাটার চিত্র এরকম বলে ইটভাটায় নিয়োজিত শ্রমিকরা জানান।
শ্রম আইনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান করা। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা সুবিধা প্রতিটি শ্রমিকের বৈধ এবং আইনগত অধিকার। শ্রম আইন ২০০৬ এর অধীনে অন্তর্ভুক্ত পেশাগত স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়গুলো হলো পরিচ্ছন্নতা, পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল এবং তাপমাত্রার ব্যবস্থা, আলোর ব্যবস্থা, অগ্নিসংক্রান্ত ঘটনা, কৃত্রিম আর্দ্রকরণ, জনবহুলতা, অতিরিক্ত ওজন, ব্লিডিং যন্ত্রপাতির সুরক্ষা, যন্ত্রপাতিকে ঘেরাওকরণ, বিস্ফোরক বা দাহ্য গ্যাস, বিপজ্জনক ধোঁয়ার বিষয়ে সতর্কতা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার ও ঝূঁকি মূল্যায়ন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ তারেক উর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ইটভাটার শ্রমিকরাই বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এইসব কারখানায় ধূলাবালি ওড়ে বেশি। যার কারণে এখানকার নিয়োজিত শ্রমিকরা ফুসফুস সংক্রমণ এ্যাজমা, ফিওপিডি রোগে আক্রান্ত হন বেশি। কর্মপরিবেশের দূষণ, কায়িক শ্রম, নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে ব্যবহার না করা, অধিক সময় বিরতিহীনভাবে কাজ করা, একই কাজ বারবার করা ইত্যাদি দীর্ঘ সময়ে শ্রমিকরা নানা রোগ ও শারীরিক জটিলতায় ভুগতে পারেন। দেশের শ্রম আইনে স্বাস্থ্যসেবা বাধ্যতামূলক করলেও অধিকাংশ কল-কারখানায়ই তা মানা হচ্ছে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
হিরো ব্রিক্স এর ম্যানেজার মোঃ রেজাউল ইসলাম বলেন, এখানে ইটভাটায় শ্রমিকদের চিকিৎসার খরচ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, কেউ যদি কাজ করতে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয় সে জন্য চিকিৎসা খরচ বহন করা হয়। শ্রমিকদের মহাজনরা তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করেন।
এ ব্যাপারে হিরো ব্রিক্স এর শ্রমিকদের মহাজন মোঃ জিল্লার এ প্রতিবেদককে বলেন, শ্রমিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কোন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো জবাব দিতে পারেননি।