ইয়াবাকে বলা হচ্ছে বড় মাছ-ছোট মাছ : দাম বেড়েছে মাদকের

প্রকাশঃ ২০১৯-০৬-১০ - ১২:৪৬

কৌশল পল্টাচ্ছে মাদক কারবারীরা

কামরুল হোসেন মনি : ‘চলে যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ শ্লোগানে দেশব্যাপী চলছে মাদকবিরোধী অভিযান। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিদিন কোথাও না কোথাও অভিযান চালাচ্ছে। গ্রেফতার করছে মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের। অভিযানের কারণে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছে মাদক কারবারীরা। নগরীতে মাদকের সরবরাহ কমেছে। মাদক ব্যবসায়ীরা আশ্রয় নিচ্ছে গ্রামে। তাছাড়া অভিযানে মাদকের জোগান যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে ফেনসিডিল, ইয়াবা, হোরোইন ও গাঁজার দামও। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মোবাইল ট্র্যাকার সুবিধা না থাকার কারণে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা অভিযানে আটক হলেও পৃষ্ঠপোষকতারা রয়েছে ধরা ছোয়ার বাইরে। এ কারণেই এই দপ্তরে মোবাইল ট্র্যাকার ব্যবস্থার জন্য স্বারাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
জানা গেছে, গত মে মাসে খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ‘ক’ ও ‘খ’ সার্কেল এবং বিভাগীয় গোয়েন্দা বিভাগ অভিযান চালিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে ১৫৩টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ৩৭ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। মামলা দায়ের করা হয় ৩৪টি। মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৪৬২ গ্রাম গাজা, গাজা খাওয়ার সরঞ্জাম, গাজার গাছ ২টি, ইয়াবা ৪৫০ পিস এবং ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয় ২শ’ মিলি গ্রাম। অভিযানের সময় খুচরা ও পাইকারি মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার হলেও পৃষ্টপোষকতারা রয়েছে ধরা ছোয়ার বাইরে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে মোবাইল ট্র্যাকার ব্যবস্থা না থাকার কারণে মাদক বিক্রির পৃষ্ঠপোষকতার মোবাইল ট্র্যাকিং করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মাদক বিকিকিনির গডফাদার ও পৃষ্টপোষকতারা পার পেয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক (অপারেশন) মোঃ বজলুর রহমান রোববার দুপুরে এ প্রতিবেদককে বলেন, তাদের সংস্থার কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে মাদক বিরোধী অভিযানে গিয়ে মাদকসহ মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের আটক করছেন। গ্রেফতার এড়াতে মাদক ব্যবসায়ীরা ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করছেন। যার কারণে অভিযানে আগেই তারা স্থান ত্যাগ করছেন। আমাদের মোবাইল ট্র্যাকিং ব্যবস্থা থাকলে খুব সহজে মাদক ব্যবসায়ীদের অবস্থান সনাক্ত করা যেতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে মোবাইল ট্র্যাকার ব্যবস্থার করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। আশাকরি খুব দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবেন।
খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ রাশেদুজ্জামান রোববার এ প্রতিবেদককে বলেন, অন্য সব আইন শৃঙ্খলাবাহিনীতে নিজস্ব ট্র্যাকার মেশিন রয়েছে। যার কারণে তারা মোবাইল ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে অপরাধিদেরকে খুব সহজে সনাক্ত করতে পারছেন। আমাদের মোবাইল ট্র্যাকার থাকলে মাদক ব্যবসায়ীদের অবস্থান সনাক্ত করতে সহজ হতো।
এদিকে মাদক বেচাকেনার স্পটগুলোর ওপর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর অব্যাহত নজরদারির কারণে বিক্রেতারা নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। জানা গেছে, শহরের মাদক ব্যবসায়ীরা শহরতলী ও দুর গ্রামে আশ্রয় নিয়ে মাদক তুলে দিচ্ছে আসক্তদের হাতে। অভিযান শুরুর পর গ্রেফতার এড়াতে শহর ছেড়ে গ্রামে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অধিকাংশ মাদক ব্যবসায়ী। তারা এখন মাদক কেনা-বেচা করছেন বিকাশের মাধ্যমে। মোবাইলের মাধ্যমে মাদকসেবীদের গ্রামে ডেকে নিয়ে মাদক কেনাবেচা করছে। শহরের মধ্যে স্কুল ছাত্রদেরকে টাকার বিনিময়ে মাদক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠাচ্ছেন। অভিযানের কারণে মাদকের দাম বেড়েঠে দণন-তিনগুন। ৮০-১০০ টাকার ইয়াবা এখন ২০০-৩৫০ টাকা, ফেনসিডিল ৬০০-৮০০ টাকার পরিবর্তে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গাজা ২৫ গ্রাম ৯০০-১২০০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পরিদর্শক মো: মোসাদ্দেক হোসেন জানান, ভিন্ন কৌশলে মাদক বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন পেশার আড়ালে মাদক ব্যবসা পরিচালনা হচ্ছে। তিনি গত ১২ মে নগরীর রয়েল মোড় ডাচ বাংলা ব্যাংক এটিএম বুথের সামনে থেকে ফেনসিডিলসহ শুভ সাহা বদ্যে নামে এক ফেনসিডিল ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। গ্রেফতারকৃত শুভ ঈগল কাউন্টারের টিকিট বিক্রি করতো। এই পেশার আড়ালে সে ফেনসিডিল বিক্রি করতো। গত ৬ মাস ধরে ফেনসিডিল বিক্রির জড়িত বলে শুভ স্বীকার করেন। উপ-পরিদর্শক মো: মোসাদ্দেক হোসেন জানান, মাদক বিক্রেতারা এখন ইয়াবার নামের পরিবর্তে ‘বড় মাছ-ছোট মাছ, কবুতর শব্দগুলো ব্যবহার করছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের ভাষায় বড় মাছ হচ্ছে ইয়াবা (আর-সেভেন) দাম সাড়ে ৩শ’ টাকা এবং ছোট মাছ হচ্ছে ইয়াবা (এমডাব্লিউ)। মাদক বিক্রেতারা বিকাশের মাধ্যমে মাদকসেবীদের কাছ থেকে টাকা লেনদেন করছেন।
‘খ’ সার্কেলের পরিদর্শক মোঃ সাইফুর রহমান রানা জানান, প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীরা এখন বাসায় কোন মাদক রাখছেন না। ৮ম শ্রেনী এক স্কুল ছাত্রদেরকে দিয়ে ইয়াবা সাপ্লাই দিচ্ছে। এক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আটক করলে স্কুল ছাত্রদের মাদক বিক্রি করা হচ্ছে বলে স্বীকার করেন। বর্তমানে মাদক তিন হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে মাদক সেবিদের হাতে। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা মাঝে মধ্যে আটক হলেও মাদকের মুল পৃষ্টপোষকতারা রয়েছে ধরা ছোয়ার বাইরে। মাদক বিক্রেতারা রিমান্ডেও সহজে স্বীকারও করছেন না। আমাদের সংস্থায় ট্র্যাকার মেশিন থাকলে তাহলে ওই পৃষ্টপোষকতার মোবাইল ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে তাকে সহজে সনাক্ত করা যেতো।
‘ক; সার্কেলের পরিদর্শক মোহাম্মদ হাওলাদার সিরাজুল ইসলাম বলেন, মোবাইলে মাধ্যমে মাদক বিক্রি ও টাকার লেনদেন হওয়ার কারণে মাদক বিক্রেতাদের ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে। তারা ঘন ঘন স্পষ্ট পরিবর্তন করছেন। তারপরেও আমাদের অভিযানে মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের আটক করা হচ্ছে।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদক বিরোধী অব্যাহত অভিযান এবং বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনার পর শহরে মাদক ব্যবসা কমে গেছে। তবে মাদকাসক্তদের চাপ বেড়েছে গ্রামে। শহর ছেড়ে এখন গ্রামে মাদকের খোজে যাচ্ছে আসক্তরা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মটরসাইলে নিয়ে মাদকের খোজে গ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মাদক সেবারীরা। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে নির্ধারিত স্পষ্টগুলোতে যাচ্ছে তারা।