কয়রায় বিনা চাষে আলু উৎপাদনে কৃষকের সাফল্য

প্রকাশঃ ২০২০-০২-০১ - ১৪:৫২

ইমতিয়াজ উদ্দিন, কয়রা : জমি চাষ না করেই আলু লাগানোয় কৃষক রবীন্দ্র ঢালীকে অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। বাড়ির পাশের স্বরাজ কুমার বলেই দিয়েছিলেন, ‘কষ্ট করে লাভ নেই। বিনা চাষে আলু হয় না। কথায় আছে, ষোল চাষে আলু।’ কিন্তু মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে সেই উপহাসকারী প্রতিবেশী থেকে শুরু করে এলাকার মানুষ অবাক বিশ্বয় নিয়ে তাকিয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ ঢালীর বিনা চাষের আলুর খেতের দিকে।
খুলনা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলা সদর। সেখান থেকে আরো চার কিলোমিটার গেলে ৩নং কয়রা গ্রাম। ওই গ্রামের কৃষক রবীন্দ্রনাথ ঢালীর বসতবাড়ি লাগোয়া ১২ বিঘা জমির প্রায় পুরোটাই অনাবাদি। শুধু মাঝখানের ১০ শতক জমিতে সারি সারি সবুজ আভা ছড়িয়ে আছে গোল আলুর গাছ। বিনা চাষে রোপণ করা ওই গোলআলুর সবুজ গাছের সঙ্গে এলাকার কৃষকের বিস্ময় আর আগামীর স্বপ্নও যেন ফুটে উঠেছে।
সরেজমিন ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোনায় আক্রান্ত কয়রা উপজেলায় মাত্র একটি ফসল হয়। সেটা বর্ষা মৌসুমে; আমন ধান। অনেকে অবশ্য নোনা পানিতে চিংড়ি চাষ করে। যারা চিংড়ি করে না, তাদের জমি বাকি সময় অনাবাদি থাকে। সেই অনাবাদি জমিতে এবারই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ‘বিনা চাষে’ আলু রোপণ করেন রবীন্দ্র ঢালী। লবণাক্ততা সহিষ্ণু আলুর নতুন জাতের বীজ থেকে শুরু করে সার্বিক সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই বা বারি) সরেজমিন গবেষণা বিভাগ।
ওই বিভাগের বৈজ্ঞানিক সহকারী জাহিদ হাসানই বিনা চাষে আলু রোপণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন রবীন্দ্র ঢালীকে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে তিনি ঝুঁকি নেন। ১০ শতক জমিতে রোপণ করেন ৮০ কেজি আলুর বীজ। প্রথম দিকে অনিশ্চয়তা থাকলেও মাত্র দেড় মাস পর মুখে হাসি ফুটতে শুরু করে তাঁর।
চাষের ধরন ব্যাখ্যা দিয়ে রবীন্দ্র ঢালী বলেন, ‘ধান কাটার পর জমি তখনো পুরোপুরি শুকায়নি, জমিতে কাদা ছিল। সেই কাদামাটির ওপর দড়ি টানিয়ে সারি সোজা করে বীজ আলু বসিয়ে দিয়েছিলাম। এক সারি আলু থেকে আরেক সারির দূরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার। প্রতি সারির একটি বীজ থেকে আরেকটির দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার। আলুর ওপর গোবর ছড়িয়ে তার ওপর খড়কুটা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। এতেই সোনা ফোলেছে আলুর খেতে।’
তবে বিনা চাষে আলুর ফলন ভালো হয়কিনা এই দ্বিধা থেকে কিছু জমিতে চাষ করে আলু লাগিয়েছেন তিনি। হাতের ইশারায় সেই খেত দেখিয়ে বললেন, ‘ওই খেতে তার ১৬ বার মাটিরচাষ দেয়া লেগেছে, মাটি একেবারেই ধুলার আকার নিলে সেখানে রোপন করেছেন বীজ আলু। আর সেচ, সার, কিটনাসক মিলিয়ে অনেক খরচ হয়ে গেছে। তাছাড়া আলু গাছের গোড়া বাধানো আর লেবার খরচও অনেক। সেই তুলনায় বিনা চাষে একেবারে মাগনায় ফলন পেয়েছেন এই আলুর খেতে।’ কৃষক রবিন্দ্র নাথের দেখাদেখি কয়রার আরও অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন চাষহীন পদ্ধতিতে আলু রোপণে।
কৃষক রবিন্দ্রনাথ ঢালীর স্ত্রী কৃষ্ণা রানী ঢালী ‘বিনা চাষের’ আলুর ক্ষেতের মাটি খুঁড়ে গাছ তুলে দুই হাত ভরে আলু দেখিয়ে বলেন, ‘আলুর আকারও বেশ বড়। কয়েক দিন পর বাজারে বিক্রি করা যাবে।’
বিনা চাষে আলু রোপণে সফলতা পেয়ে প্রচন্ড খুশি কৃষক রবিন্দ্রনাথের পরীবার। রবিন্দ্র ঢালী বলেন, প্রথমে নিচু জমিতে বিলের মধ্যে চাষ না করে আলু লাগাতে আগ্রহী ছিলাম না। পরে কৃষি গবেষণা বিভাগের পরামর্শে আগ্রহী হয়ে উঠি। চাষাবাদের পর সুন্দর গাছ দেখে ও গাছের গোড়ায় আলু দেখে স্থানীয় আরও অনেক কৃষককে বিনা চাষে আলু আবাদের পরামর্শ দিয়েছি। এই পদ্ধতিতে খরচ কম আর আলুর ফলন ভালো হওয়ায় ভবিষ্যতে পুরো জমিতেই আলু রোপন করবেন বলে জানান তিনি।
কৃষি গবেষণা কয়রার বৈজ্ঞানিক সহকারী জাহিদ হাসান বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে আমন ধান কাটার পর মাটি শুকাতে অনেক বেশি সময় নেয়ায় সঠিক সময়ে আলু চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ধান কাটার পর জমি ফাঁকা হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিনা চাষে আলু আবাদের সুযোগ ঘটে। এই পদ্ধতিতে আলুর আবাদ করলে আলু বেশি সুস্বাদু হয় এবং এর আকারও অনেক বড় হয়।
কৃষি গবেষণা বিভাগ খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হারুনর রশীদ বলেন, কয়রায় অনেক জমি আমন ধান কাটার পর পড়ে থাকে। ওই পতিত জমিতে যদি এলাকার কৃষকরা বিনা চাষে আলু উৎপাদন কৌশল দেখে ও শিখে নিয়ে চর্চা করেন তবে তাঁরাও লাভবান হবেন। আর এভাবেই পরিবার ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় তাঁরাও অবদান রাখতে পারবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
তিনি আরও বলেন, কয়রায় প্রথমবারের মতো বিনা চাষে আলু আবাদ করে সফলতা এসেছে। ধীরে ধীরে চাষাবাদ বাড়াতে পারলে স্থানীয় কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এটি যেমন কৃষকের জন্য অনেক সাশ্রয়ী হবে, তেমনি অনেক পতিত জমিও চাষের আওতায় আসবে।