খুমেক হাসপাতালে ধর্ষিতার আর্তনাদ : ‘ওরা মুখ বেঁধে ধর্ষণ করেছে, আমি ওদের শাস্তি চাই’

প্রকাশঃ ২০১৮-০৬-১১ - ১৭:৫৬

ধর্ষিতার অভিযোগে তিন ধর্ষক আটক, ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন

কামরুল হোসেন মনি : নগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকায় আবির ও টুটুল মিলে মোহাম্মদনগর মহিলা কামিল মাদ্রাসার ৫ম শ্রেণির ছাত্রী শিশু কন্যাকে (১২) ধর্ষণ করে। সেটি আবার ভিডিও করে ওই ধর্ষণকারীরা। ওই ভিডিওটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে রাজু শেখ ওই ধর্ষিতা শিশু কন্যাকে খারাপ কাজ করতে বাধ্য করায়। বিষয়টি লোকমুখে ভয়ে কাউকে বলতে পারছে না মেয়েটি। এক পর্যায়ে ধর্ষণকারীদের স্ত্রীদের বললে উল্টো তাকে মারধর করার হুমকি ধামকি প্রদান করে। এই ক্ষোভে গত ৩ জুন মেয়েটি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। বর্তমানে মেয়েটি খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারিতে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ‘আমি ওই ধর্ষণকারীদের উপযুক্ত শাস্তি চাই’ এমন বুকফাটা আর্তনাদ ধর্ষিতা মেয়েটির। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মেয়ের বুকের ১০ শতাংশের বেশি আগুনে পুড়ে ঝলসে গেছে। বর্তমানে সে আশঙ্কামুক্ত থাকলেও মানসিক পরিস্থিতি তার মোটেও ভালো নেই।
এদিকে এ ঘটনায় ধর্ষিতা মেয়ের বাবা বাদী হয়ে খুলনা সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় তিন জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারভুক্ত তিন আসামিকে পুলিশ রোববার দুপুরে গ্রেফতার করেছেন। আটককৃতরা হচ্ছে মোঃ আজিজ শেখের পুত্র মোঃ আবির শেখ (১৫), মৃত মকবুল শেখের পুত্র টুটুল শেখ (২৮) ও আজিজ শেখের পুত্র মোঃ রাজু শেখ (২০)। তারা নগরীর সোনাডাঙ্গা মেইন রোডে রশিদ সরদারের ভাড়াটিয়া ছিলেন। মামলায় সোনাডাঙ্গা মডেল থানার এসআই দিপক কুমার পাল রোববার বেলা সাড়ে ৩টায় এজাহারভুক্ত তিন আসামিকে আটক করেছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছে এসআই দিপক কুমার পাল।
খুমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন মাদ্রাসার ছাত্রী (১২) বলেন, কয়েক মাস আগে নগরীর সোনাডাঙ্গা মেইন রোডে রশিদ সরদারের ভাড়াটিয়া আবির রাত ৮টার দিকে তাকে ভাত দেখানোর জন্য ঘরে ডাকে। ঘরের ঢোকার সাথে সাথে তার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে। আর টুটুল ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। এরপর তারা তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এ সব করার সময় ধর্ষিতা ছাত্রী বলে আমি আপনাদের ফুফা বলে ডাকি, আমি আপনাদের মা এর মতো আমার সাথে এসব খারাপ কাজ করেন না, কিন্তু মেয়েটির আকুতিতে তাদের মন গলেনি। পরে টুটুল ও আবির ধর্ষণের চিত্র মোবাইলফোনে ভিডিও ধারণ করেন। ওই ভিডিওটি রাজু নিয়ে বলে তুই (মাদ্রাসাছাত্রী) ওদের সাথে যা করেছিস সব ভিডিও আমার কাছে আছে। এখন আমার সাথে ওইসব করতে হবে, না করলে সবাইকে বলে দেবো ও ইন্টারেনেটে তোর ভিডিওটি ছেড়ে দিবো। বিষয়টি মাদ্রাসাছাত্রী লোকজনের ভয়ে কাউকে বলতে পারতো না। নরপিশাচদের হাত থেকে বাঁচতে টুটুলের বউ পান্না ও রাজুর বউ রুপা এবং আবিরের প্রেমিক বৃষ্টিকে জানায়। তারা এসব শুনে কাউকে না বলতে নিষেধ করে উল্টো তাকে হুমকি ধামকি দেয়। গত ৩ জানুয়ারি এই বিষয় নিয়ে জানাজানি হলে ওইদিন রাতে মাদ্রাসাছাত্রী ঘরের মধ্যে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই মেয়েটি এ প্রতিবেদককে বলে ‘ভাই যারা আমাকে মুখ বেঁধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। তারা যেন আর কারোর সর্বনাশ করতে না পারে।
ওই দিন স্থানীয় একটি ফার্মেসি থেকে মলম ও ওষুধ দিয়ে তালায় নিয়ে যান তার মা রাবেয়া।
মেয়ের মা রাবেয়া বলেন, তার স্বামী আল আমিন সরদারের নগরীর নিউমার্কেটে ফলের দোকান রয়েছে। সংসারে অভাবের কারণে সে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। এ প্রতিবেদককে বলেন, ছেলেমেয়ে বলতে ওই মেয়েটি ছাড়া আর কেউ নেই। আমরা গরিব মানুষ, কার কাছে বিচার চাইবো? আমার মেয়ের জীবন ওরা নষ্ট করে দিয়েছে। আমি এর উপযুক্ত শাস্তি কামনা করছি। এ সব সহ্য করতে না পেরে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা চেষ্টা চালায়। লোকজনের ভয়ে তালায় নিয়ে আসি। মেয়ের শরীরের অবস্থা অবনতি হওয়ায় গত শুক্রবার রাতে খুমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করানো হয়।
সোনাডাঙ্গা থানার ওসি (তদন্ত) বায়জিদ আকন এ প্রতিবেদককে বলেন, ধর্ষিতার পিতা মোঃ আল আমিন সরদার বাদী হয়ে তার মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-১৬। ধর্ষণকারীদের ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন চেয়ে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. ফরিদ উদ্দিন বলেন, মেয়েটির ভাষ্য মতে, কয়েক মাস আগে দুইজন লোক তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। বিষয়টির বিচার চাওয়ায় এক মহিলা তাকে মারপিট করেছে। এই ক্ষোভে সে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। তার বুকে ১০ শতাংশের বেশি আগুনে ঝলসে গেছে। বর্তমানে ওয়ান স্টপ ক্রাইম সেন্টার (ওসিসি) তত্ত্বাবধানে তাদের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার কো-অর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, ওই সব ধর্ষণের মামলাগুলোয় দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি প্রদান করতে হবে। আর নারীদেরকে নিজেদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে যাতে স্বামীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটালে যাতে প্রতিবাদ করতে পারে। অনেক স্ত্রী স্বামীর ঘর ছাড়া তাদের কোন জায়াগা থাকে না বলেই স্বামীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না। এ জন্য নারীদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য ব্যবস্থা করা ও ধর্ষণকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে পারলে এ ধরনের ঘটনা অনেকটা হ্রাস পাবে।