খুলনার স্বাস্থ্য খাতে দুদক আতঙ্ক : রাঘব বোয়াল ধরা ছোঁয়ার বাইরে

প্রকাশঃ ২০১৯-০৭-১৬ - ১১:৩০

সাতক্ষীরায় টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি

কামরুল হোসেন মনি : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবজাল হোসেন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত তার অঢেল সম্পদের চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর এখন খুলনা স্বাস্থ্য খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আতঙ্কে ভুগছেন। ইতোমধ্যে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের সহকারী প্রধান (এমআইএস) মোঃ জোবায়ের হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অবৈধ অর্থ উপার্জন, বিদেশে অর্থ পাচার ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এদিকে যন্ত্রপাতি না কিনেই সাড়ে ১৬ কোটি টাকার বিল উঠিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে দুদকে মামলা না হওয়ার আশ্বাস দিয়ে খুলনা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তার (চঃ দাঃ) বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, সাতক্ষীরার সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমান, সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর কিপার একেএম ফজলুল হক, হিসাবরক্ষক আনোয়ার হোসেন, মেসার্স বেঙ্গল সায়েন্টিফিক মালিক জহির উদ্দিন সরকার, আব্দুর ছাত্তার সরকার, আসাদুর রহমান, কাজী আবু বকর উদ্দিন এবং স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী আবদুল কুদ্দুস পরস্পরের যোগসাজসে সাড়ে ১৬ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার নাম করে সেগুলো না কিনে পুরো টাকাই আত্মসাৎ করেন। এ ঘটনায় একাধিক তদন্তও হয়। শেষ পর্যন্ত দুদকে মামলাও হয়। এর আগেও খুলনা স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর থেকে বিষয়টির তদন্ত হয়। তদন্তের পর ওই দপ্তরের প্রধান সহকারী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা (চঃ দাঃ) এস এম জাহাতাব হোসেন ডিপার্টমেন্টাল তদন্তে গিয়ে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর কিপার একেএম ফজলুল হক ও হিসাবরক্ষক আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। বিনিময়ে তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু সর্বশেষ যখন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় তখনই বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
জানা যায়, প্রশাসনিক কর্মকর্তা (চঃ দাঃ) এস এম জাহাতাব হোসেন অফিস সহকারী থেকে পদোন্নতি বোর্ডের মাধ্যম ছাড়া জালিয়াতি করে প্রধান সহকারী পদে পদোন্নতি নেন। উক্ত পদে কর্মরত থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ বেতনে (চঃ দাঃ) প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি নিয়েছেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের আদেশক্রমে। কিন্তু প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিজ বেতনে (চঃ দাঃ) পদোন্নতি পদায়নের এখতিয়ার কেবলমাত্র মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাখালী ঢাকার। এ বিষয়ের ওপর সঠিক তদন্ত করলে বিষয়টির আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রটি জানায়।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডাঃ রাশেদা সুলতানা সোমবার এ প্রতিবেদককে জানান, সাতক্ষীরায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকার বিল উঠিয়ে আত্মসাতের ঘটনার বিষয়টি তার দপ্তর থেকে একটি তদন্ত করা হয়। সেই তদন্তে তার দপ্তরের প্রশাসনিক কর্তকর্তা (চঃ দাঃ) এস এম জাহাতাব হোসেনের বিরুদ্ধে সাড়ে ৩ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের যে অভিযোগ উঠেছে তা সঠিক না। বিষয়টি হাস্যকর। একটি চক্র বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য গুজব ছড়াচ্ছেন।
এ ব্যাপারে ওই দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (চঃ দাঃ) এস এম জাহাতাব হোসেন তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে এ প্রতিবেদককে বলেন, সাতক্ষীরায় যন্ত্রপাতি ক্রয়সংক্রান্ত টাকা আত্মসাতের বিষয়ে এই দপ্তর থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। সেই তদন্ত কমিটিতে তিনি একজন সদস্য। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনটি পরিচালকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদারের কাছ থেকে সঠিক প্রক্রিয়ায় যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে কী না তা যাচাইয়ের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালককে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির অন্যারা হচ্ছেন সাতক্ষীরার কলারোয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইচএস ও দেবহাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইসএস রয়েছে। আগামী ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
এদিকে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের সহকারী প্রধান জোবায়ের হোসেনকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনায় স্বাস্থ্য দপ্তরে দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তারা নিজেদের বাঁচাতে দৌঁড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, জোবায়ের হোসেন একই কর্মস্থলে প্রায় ২২ বছর ধরে রয়েছেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি রাজস্ব খাতে ও এর আগে ১৯৯৭ সাল থেকে ওই পদেই প্রকল্পের আওতায় চাকরি করছেন। একই কর্মস্থানে দীর্ঘদিন থাকার কারণে প্রভাব বিস্তার ও চাকরিতে তদবিরের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ভুয়া বিল-ভাউচার, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া খুলনায় তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এদিকে খুলনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম না কিনে প্রায় ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র জালিয়াতি, বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তর ও সিভিল সার্জন অফিসে দুর্নীতিতে জড়িত অনেকে এখনও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় স্বপদে বহাল থাকার অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে নিজেদের বাঁচাতে অনেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে লবিং শুরু করেছেন।