খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ওষুধ প্রতিনিধিদের সপ্তাহে ৬ দিনই ভিজিট!

প্রকাশঃ ২০২০-০৯-০৩ - ১৯:৩৭

ছবি তোলায় সাংবাদিককে দেখা নেয়ার হুমকি
দালালদের সাথে হাসপাতালের স্টাফদের সখ্যতা, রোগী পাঠালেই কমিশন
চিকিৎসা নিতে আসা ভুক্তভোগীরা পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন

কামরুল হোসেন মনি : খুলনা জেনারেল হাসপাতালে দিনকে দিন ওষুধ প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচন্ড ভীড়ে যেখানে রোগীদের দাঁড়ানোর কষ্টকর, সেখানে ওষুধ প্রতিনিধিদের দীর্ঘ লাইন। আগে ওষুধ প্রতিনিধিদের ভিজিট শেষ হওয়ার পর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীকে ডাক্তারদের চেম্বারে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। সপ্তাহে ৬দিনই ওষুধ প্রতিনিধিরা ভিজিটে আসেন। খুলনা জেনারেল হাসপাতালে বহি:র্বিভাগ ও জরুরি বিভাগের এই চিত্র। বুধবার ওষুধ প্রতিনিধিদের এসব অনিয়মের ছবি  তোলার সময় এ প্রতিবেদককে দেখা নেওয়া হুমকি দেন দু’জন ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধি । ওষুধ প্রতিনিধিদের ভিজিটের নির্ধারিত দিন ও সময় কাগজ কলমে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে চিত্র একেবারেই ভিন্ন। চিকিৎসকদের সাথে ওষুধ প্রতিনিধিদের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত গোপন সখ্যতা থাকায় কেউ এই নিয়মের ধার ধারেন না, উল্টো রোগীদের লাঞ্ছিত হওয়ার মত ঘটনা ঘটছে। জরুরি বিভাগে কর্মরত স্টাফ ও আউটসোর্সিং এবং ফ্রি  সার্ভিসদের সাথে ওষুধ প্রতিনিধি ও বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার দালালদের সাথে সখ্য থাকারও প্রমান পাওয়া গেছে।
এর আগে ২০১৭ সালে ফুলতলা উপজেলার আলকা গ্রামের বাসিন্দা রোগী এসএম বুলবুল আহমেদ শহীদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসলে হাসপাতালে থাকা ওষুধ প্রতিনিধিদের হাতে লাঞ্ছিত হন। এ সময় ওই রোগীকে কয়েকজন ওষুধ প্রতিনিধি লাঞ্ছিতসহ জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী এস এম বুলবুল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
সার্বিক বিষয়ে খুলনা সিভিল সার্জন ডা: সুজাত আহম্মেদ বলেন, ওষুধ প্রতিনিধিদের সপ্তাহে দুই বার ডাক্তারদের ভিজিট করা নির্ধারন করা দেওয়া হয়েছে। তাও দুপুর ১২টার পর থেকে হাসপাতালে ঢুকতে পারেন। ওই সময় যদি কোন রোগীও থাকে তাহলে সে রোগী চলে যাওয়ার পর প্রবেশ করবেন। তিনি বলেন, যারা হুমকি দিয়েছেন তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা জেনারেল হাসপাতালে গত কয়েকদিন সরেজমিনে গিয়ে এসব চিত্র পাওয়া যায়। বুধবার সকাল ১১টা জরুরি বিভাগে ইএমও ডা: জান্নাতুল নাঈম দায়িত্বরত ছিলেন। বাইরে রোগী ডাক্তার দেখানোর জন্য জরুরি বিভাগে টিকিট কাটতে আসেন। এ সময় দুই ওষুধ প্রতিনিধি ওই ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করেন। এ সময় তাদের এই অবৈধ কার্যক্রমের ছবি ও ভিডিও করা হয়। বিষয়টি জরুরি বিভাগের কতিপয় স্টাফ তাদেরকে ইশারায় সাংবাদিক ছবি তোলার বিষয়টি ঈঙ্গিত করেন। বিষয়টি শুনে ওই দুই ওষুধ প্রতিনিধি এই প্রতিবেদকের কাছে এসে হুমকি স্বরুপ বলে ওঠেন, লুকায় ছবি তোলেন কোনো পারলে বাইরে আসেন। দেখে নেবো আপনাকে। এই বলে তারা ডাক্তারের রুম ত্যাগ করে। পরে কয়েকজন ওষুধ প্রতিনিধি সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা দুইজন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল ওষুধ কোম্পানী রিপ্রেজেটেন্টিভ। গত সোমবারও এই প্রতিবেদক জরুরি বিভাগে অবস্থান নিলে কয়েকজন ওষুধ প্রতিনিধি এসে জটলা বাঁধে। এসময় ছবি তোলার সময় জরুরি বিভাগে কর্মরত স্টাফ জাফর ওই ওষুধ প্রতিনিধিকে সাংবাদিক ছবি তুলছে বলে তাকে অবহিত করেন। পরে তারা সটকে পড়েন।
এ ব্যাপারে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল খুলনা ডিপোর ডেপুটি ইনচার্জ কাজী নুরুল ইমাম আল মামুন বলেন, সপ্তাহে শনি ও বুধবার খুলনা জেনারেল হাসপাতালে তার কোম্পানীর ওষুধ প্রতিনিধিদের ভিজিটের দিন নির্ধারিত রয়েছে। প্রতিদিন ভিজিটে যাবার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এই প্রতিবেদককে হুমকির বিষয়টি অবহিত করলে তিনি বলেন, ওখানে দায়িত্বরত ম্যানেজার ফজর উদ্দিনের সাথে কথা বলতে বলেন। এ ব্যাপারে এরিয়া ম্যানেজার ফজর উদ্দিন বলেন, বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি। ওই ওষুধ প্রতিনিধির নাম জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
নগরীর ২৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মহিদুল হক শান্ত এ প্রতিবেদককে বলেন, গত সোমবার কিডনিজনিত সমস্যা কারণে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। সেদিন এক ওষুধ প্রতিনিধি তাকে ধাক্কা মেরে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়েন। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের সাথে ওষুধ প্রতিনিধিদের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত গোপন সখ্যতা থাকায় কেউ এই নিয়মের ধার ধারেন না, উল্টো রোগীদের লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে।
হাসপাতালে গেটের সামনে ডক্টরস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কথিত মহিলা দালাল রেনু। সবাই তার কাছে রেনু নামে পরিচিত। তার সাথে হাসপাতালের ফ্রি সার্ভিস সোবহান, ইসমাইল ও জরুরি বিভাগের কতিপয় স্টাফদের সখ্যতা রয়েছে। সাধারণ রোগীরা টেস্ট করতে আসলে তারাই ওই কথিত মহিলা দালাল রেনুকে ফোন করে রোগীদের পাঠিয়ে দেন। বিনিময়ে তারা টেস্টের ওপর কমিশন পান। কেউ জন প্রতি ১০০ টাকা কেউ বা ২০০ টাকা প্রতি রোগীর জন্য কমিশন পেয়ে থাকেন। গতকাল কথিত মহিলা দালাল রেনুর ছবি তুলতে গেলে সে সটকে পড়েন। এর আগে ওই দালাল রেনু পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর ভ্রাম্যমান আদালতে মাধ্যমে তাকে সাজাও দেওয়া হয়।
খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আরাফাত হোসেন পল্টু বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে এই হাসপাতাল এলাকায় আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেই সুবাদে প্রতিদিন সকালে হাসপাতালে একবার যাওয়া আসা হয়। প্রতিদিনই দেখি বহি:র্বিভাগের ও জরুরি বিভাগের সামনে বিভিন্ন কোম্পানীর ওষুধ প্রতিনিধিরা দীর্ঘ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কোন রোগী ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। সপ্তাহে দুই দিন ওষুধ প্রতিনিধিদের ভিজিট করা কাগজ কলমে বাস্তবে কোন মিল নেই। অনেক অসুস্থ রোগীদের দাঁড় করিয়ে ডাক্তারদের দেওয়া প্রেসক্রিপশন টানা হেঁচড়া করতেও দেখেছি। এছাড়া বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দৌরাত্ম তো রয়েছে। সাধারণ রোগীদের ভোগান্তী যাতে লাগব হয় সে জন্য তিনি পুলিশের উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ভ্রাম্যমানা আদালত অভিযানের দাবি জানান।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনা ইউনিটের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, সরকারি হাসপাতালে সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে অনেক ভোগান্তির খবর পত্র-পত্রিকায় চোখে পড়ে। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ যদি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে এই ভোগান্তি কোন দিনও বন্ধ সম্ভব না।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ফুলতলা উপজেলার আলকা গ্রামের বাসিন্দা রোগী এসএম বুলবুল আহমেদ শহীদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসলে হাসপাতালে থাকা ওষুধ প্রতিনিধিদের হাতে লাঞ্ছিত হন। এ সময় ওই রোগীকে কয়েকজন ওষুধ প্রতিনিধি লাঞ্ছিতসহ জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী এস এম বুলবুল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠণ করেন। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ ওষুধ প্রতিনিধিদের ভিজিট সাময়িকভাবে বন্ধ  ঘোষণা করেন। এছাড়া দোষীদের বিরুদ্ধে আজীবন হাসপাতালে প্রবেশের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।