খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ওষুধ প্রতিনিধিরা বেপরোয়া!

প্রকাশঃ ২০১৯-০৩-২৪ - ১৬:০৫

কামরুল হোসেন মনি : খুলনা জেনারেল হাসপাতালে কতিপয় চিকিৎসকের কারণে ওষুধ প্রতিনিধিরা দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। উপঢৌকন নেওয়া চিকিৎসকেরা ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশন) নিজস্ব কোম্পানির ওষুধ লিখছেন কি-না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীদের আটকিয়ে প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলছেন। রোগীরাও তাদের গোপনীয়তা বিষয় নিয়েও আতঙ্কে থাকেন। এতে রোগীদের চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এমন পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে এর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ি থাকবে বলে ভুক্তভোগী রোগীদের অভিমত।
গত কয়েকদিনে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে গেলে এ চিত্র ফুটে ওঠে। গত ২২ মার্চ সকালে ওই হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন) ডাঃ চম্পক রায়কে এক ওষুধ প্রতিনিধির মোটরসাইকেলযোগে হাসপাতাল চত্বর ত্যাগ করতে দেখা যায়। ওই সময় হাসপাতালে ওই চিকিৎসকের খোঁজ নিতে গেলে কর্তব্যরত নার্সরা বলেন তিনি চেম্বারেই আছেন। কিন্তু তার চেম্বারে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে জানা গেছে ইনসেপটা কোম্পানির প্রতিনিধি বশিরের সাথে ওই চিকিৎসক বাইরে গেছেন।
হাসপাতালের সিভিল সার্জন ডাঃ এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এর কোনো প্রমাণপত্র আপনার কাছে থাকলে তাহলে ছবিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করেন কোনো সমস্যা নেই।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দেখা গেছে, একজন মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে গেলেই দেখা মিলে ডজন ডজন বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ প্রতিনিধিদের জটলা। হাসপাতালে কোনো রোগী ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে চেম্বারে প্রবেশ করলেই দেখা যায় চিকিৎসকদের সঙ্গেই বসে গল্পে মেতে রয়েছেন। কেউ বা রোগীর বসার স্থান দখল করে বসে আছেন। সম্প্রতি হাসপাতালের কর্মরত স্টাফদের সাথে রোগীর বসার স্থলে ওষুধ প্রতিনিধিদের বসাকে নিয়ে কথা তুললে তাকে অকথ্য ভাষায় উক্তি করেছেন। চিকিৎসকদের সাথে ওষুধ প্রতিনিধিদের সখ্যতা থাকায় স্টাফরাও মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারেন না।
গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নার্গিস সুলতানা পলি এ প্রতিবেদককে বলেন, ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র কয়েকজন ওষুধ প্রতিনিধি তাকে জোঁকের মতো ঘিরে ধরেন। প্রথমে তিনি ওই প্রেসক্রিপশন দেখাতে না চাইলে এক প্রকার তার কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন ছিনিয়ে নিয়ে ছবি তুলতে থাকেন। তিনি বলেন, আমার ব্যক্তিগত অনেক সমস্যা থাকতে পারে। কেন তারা এভাবে জোর করে ছবি তুলবেন। আমি মেয়ে না হয়ে যদি পুরুষ হতাম তাহলে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য দায়ি থাকতো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, চিকিৎসকদের কারণে আজ এমন পরিস্থিতি। এ জন্য কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারেন না।
ওষুধ প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন চুক্তিতে চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও হাতুড়ে চিকিৎসকদের তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখতে প্রভাবিত করেন তারা। এসব ক্ষেত্রে যেসব ডাক্তারদের হাঁকডাক যত বেশি তাদের রেট তত বেশি।
গত কয়েকদিনে হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চিকিৎসকদের কর্মস্থলের আশপাশে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির যাতায়াত। রোগী ও স্বজনদের তুলনায় ওষুধ প্রতিনিধির সংখ্যা বেশি থাকে।
সূত্র জানায়, ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসকেরা উভয়ে লাভবান হলেও আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রোগীরা। কেননা কোম্পানিকে খুশি রাখতে কতিপয় চিকিৎসক হাসপাতালে সরকারের বিনামূল্যে সরবরাহ ওষুধ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে না লিখে বাইরের কোম্পানির ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। সামান্য অসুস্থ হয়ে আসলেও ব্যবস্থাপত্রে স্থান পাচ্ছে বাড়তি ওষুধের নাম। দায়বদ্ধতা এড়াতেই চিকিৎসকেরা এই অনৈতিকতা করেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সপ্তাহে দুইদিন ওষুধ কোম্পানির ভিজিট নির্ধারণ করে দিলেও এই নিয়মের বাস্তবে কোনো বালাই নেই। প্রতিদিন সকাল থেকেই একাধিক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হাসপাতালের বিভিন্ন কোণে ভিড় করতে থাকে। একে একে তারা আন্তঃবিভাগ ও বহিঃবিভাগে ঢুকে পড়েন। অনেকে আবার রোগী সেজে বসে থাকেন। বহিঃবিভাগ থেকে কোনো রোগী চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হতেই তারা হাতে ছোঁ মেরে ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) কেড়ে নেন। তাদের বেপরোয়া কারণে রোগী ও স্বজনেরা বিড়ম্বনায় পড়ছে।
খুলনা শহীদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে গত বছরে ওষুধ প্রতিনিধিদের সাথে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর বাকবিতন্ডা ঘটে। এক পর্যায়ে ওষুধ প্রতিনিধিরা ওই রোগীর গায়ে হাত তুলে গায়ের জামাটা ছিঁড়ে ফেলেন। চিকিৎসকের চেম্বারে ওষুধ প্রতিনিধিদের প্রবেশকে কেন্দ্র করে এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।