চট্টগ্রাম নগরীতে কিশোর অপরাধী ও তাদের মদদদাতা করা তালিকা হচ্ছে; মাটে নেমেছে পুলিশ

প্রকাশঃ ২০২০-১০-০৫ - ১১:৩৬

 রিটন দে লিটন,চট্টগ্রাম: এলাকাভিত্তিক কিশোর অপরাধী ও তাদের মদদদাতা ‘বড় ভাইদের’ নিয়ন্ত্রণে আনতে মাঠে নেমেছে সিএমপি। পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে গতকাল শনিবার বিকাল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত নগরীর ১৬টি থানার একশ’ ৪৫ জন বিট কর্মকর্তা তাদের বিটের নির্ধারিত এলাকায় অবস্থান ও সভা করে কিশোর গ্যাং ও তাদের মদদদাতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এসব তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে তালিকা হালনাগাদ করা হবে। তারপর তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অ্যাকশনে যাবে পুলিশ।
এর আগে গত পয়লা অক্টোবর রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেয়া এক পোস্টে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সঠিক তথ্য দিয়ে কোমলমতি কিশোরদেরকে সঠিক ও আলোর পথে ফিরিয়ে আনার কাজে সহায়তার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহব্বান জানান।
সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, বিগত কয়েকবছরে নগরীতে এলাকাভিত্তিক ভয়ঙ্কর সব অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া কিশোর গ্যাং- এর লাগাম টানতে এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে পুলিশ। নবনিযুক্ত পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে ১৬ থানা এলাকায় সক্রিয় কিশোর অপরাধী চক্রের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। তালিকা ধরেই অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ কিশোর অপরাধীদের আড়ালের প্রশ্রয়দাতা ‘বড় ভাইদের’ বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
নগর পুলিশের শীর্ষ পদে দায়িত্ব নেয়ার পর গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে প্রথমবারের মতবিনিময়েই সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর হাল সময়ে পাড়া-মহল্লায় দৃশ্যমান হওয়া পশ্চিমা ধাচের ‘কিশোর গ্যাং কালচার’ ভবিষ্যত প্রজন্ম ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মন্তব্য করেন। একইসাথে দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে শহরের কোথাও কিশোর গ্যাং- নামে কোনও উৎপাত মোটেও সহ্য করা হবে না জানিয়ে এ ধরনের কালচারের নামে যারা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হবে তাদের পাশাপাশি আড়ালে থেকে ছত্রছায়া প্রদানকারী বড় ভাইদেরও কোনও ছাড় না দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এরপর সিএমপির অপরাধ বিভাগের সবকটি শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরকে ১৬ থানা এলাকার কিশোর গ্যাং- এর তালিকা হালানাগাদ করার ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। কিশোর অপরাধীচক্রের কারা কোন এলাকায় সক্রিয় রয়েছে, কোন চক্রের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে রয়েছে, কাদের বিরুদ্ধে কী মামলা রয়েছে বা নেই- বিস্তারিত সব তথ্য হালনাগাদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জোনের ডিসিরা তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম তদারক করবেন। ওই তালিকা ধরেই প্রতিটি চক্র ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
কিশোর অপরাধ নির্মূলে পুলিশি পদক্ষেপের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন দরকার উল্লেখ করে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন তো সামাজিক অনুশাসন বলতে কিছুই নেই। এ অবস্থায় পারিবারিক অনুশাসন নিবিড় ও জোরদার করতে হবে। সামাজিক অনুশাসন যেটা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেটাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। কিশোর অপরাধীদের পেছনে কোনও রাজনৈতিক প্রভাবশালীর সহযোগিতা থাকলে তা অবশ্যই বন্ধ অথবা প্রত্যাহার করতে হবে। যেসব ‘বড় ভাই’ কিশোরদের ইন্ধন দিয়ে বিপথগামী করে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করতে হবে।’
সিএমপি সূত্র জানায়, পাড়ার বখাটে, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং ইংরেজি মাধ্যমে পডুয়া ছাত্ররাও কিশোর গ্যাং কালচারে শামিল হয়েছে। রাজনৈতিক বড়ভাইদের মদদ এবং তাদের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠা কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানতে কয়েক বছর আগেই নানা উদ্যোগ নেয় পুলিশ। নগরীর তিন শতাধিক স্পটে সাড়ে পাঁচশ’ কিশোর গ্যাং বা গ্রূপের তালিকা করা হয়। পুলিশের অভিযানের মুখে সর্বশেষ গত বছরের বছরে শেষের দিকে এসে কিশোর অপরাধেিদর দাপট কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসলেও চলতি সময়ে তাদের অপতৎপরতা ফের বেড়েছে। নিত্যনতুন কৌশলে চুরি-ছিনতাই ও খুনের ঘটনায় যারা ধরা পড়ছে তাদের মধ্যে কিশোর অপরাধীর সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে।গতবছরের ২৬ আগস্ট কিশোর গ্যাং-এর বিরোধের জেরে প্রকাশ্যে স্কুলছাত্র জাকির হোসেন জনি হত্যার ঘটনাটি ছিল সবচেয়ে বেশি আলোচিত। নগরীর এমইএস কলেজ এলাকায় প্রতিপক্ষের একদল কিশোর ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে। ওই বছরে কিশোর অপরাধীদের হাতে অন্তত দশজন খুনের শিকার হয়েছিলেন।
সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সমাজের বিত্তশালী ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণরা নিজেদের গ্রূপ গঠন করছে। এরপর তুচ্ছ বিষয়েও এক গ্রুপ অন্য গ্রূপের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে হত্যাসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করছে। পশ্চিমা বিশ্বে ‘গ্যাং কালচার’ নামে পরিচিত এই বিজাতীয় সংস্কৃতির ভয়ঙ্কর আগ্রাসনে নিজেদেরকে ক্রমেই অভ্যস্ত করে তুলছে চট্টগ্রামসহ দেশের উঠতি বয়সীরা। পরিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে এই বিষয়ে সচেতন না হলে গ্যাং কালচারের এই প্রবণতা জঙ্গি বা উগ্রবাদী কর্মকান্ডে জড়ানোর মত ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করতে পারে। প্রযুক্তির প্রসারতার যুগে এসে কিশোর-তরুণদের অনেকেই ফেসবুকসহ নানা যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের গ্রূপ গঠন করে অস্তিত্ব ও কর্মকান্ডের জানান দিচ্ছে। কেউ তাদেরকে প্রশ্রয় বা মদদ দিয়ে বিপথগামী করে তুলছে, আবার স্বার্থগত দ্বন্দের জেরে তাদের কোনও কোনও গ্রূপ সহিংস-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার তিক্ত ও ভয়ঙ্কর ফলই এখন সমাজ ও রাষ্ট্র পেতে শুরু করেছে।
নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বের গ্যাং কালচারের আদলে উঠতি বয়সী কিশোর ও তরুণদের মধ্যে একই স্টাইলে চুলের ছাট দেয়া কিংবা দাড়ি রাখা, শরীরে উল্কি আঁকাসহ নানা ধরণের প্রবণতা এখন চারপাশে তাকালেই নজরে পড়ে। এরা আবার নিজ নিজ এলাকায় মাদক সেবন ও বেচাকেনা, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করছে। নগরীর পাঁচলাইশ, খুলশী, চান্দগাঁও, দেওয়ানবাজার, আগ্রাবাদ, হালিশহর ও পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের কিশোর-তরুণদের গ্রæপ রয়েছে। এরা সবাই একই বয়সের। এরা প্রাইভেট কার কিংবা মোটরসাইকেল নিয়ে রাত-বিরাতে সড়কে মহড়া দেয়। একে অপরের সাথে রেইস খেলে। টিন-এজারদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটু হিরোইজম দেখানোর প্রবণতা থাকে। কিন্তু, সেটা বাড়াবাড়ির রূপ নিয়ে ‘এন্টি হিরোইজম’ তৈরি হলেই বিপত্তি। আজকাল সেটাই দৃশ্যমান হচ্ছে সমাজের কিছু কিশোরের মধ্যে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সময়ের ব্যবধান ও নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে গ্যাং কালচার তৈরি হতে আমরা দেখেছি। অনেক সময় বঞ্চনা থেকেও কিশোরদের মধ্যে এমন দল গড়ে ওঠে। আবার কোথাও কোথাও বীরত্ব বা হিরোইজমের বশবর্তী হয়ে ছেলেরা মাস্তানিতে যুক্ত হয়। এটা সমাজে সবসময়ই অল্প-বিস্তর ছিল। তবে বর্তমানে সেটার ভয়ঙ্কর সহিংস রূপ দেখতে পাচ্ছি। খেলার মাঠে কিংবা তুচ্ছ ঘটনায় কিশোরদের মধ্যে ঝগড়া হয়। কিন্তু সেটা যাতে সহিংসতার দিকে না যায়, সে ব্যাপারে এলাকার মুরব্বি ও অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে। কিশোর-তরুণদের গঠনমূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।’