বিএনপি-জামাত কর্মকর্তাদের হাতে পূর্বাঞ্চল রেলে শতকোটি টাকা লোপাট

প্রকাশঃ ২০২০-০৯-২২ - ০২:১৮

ছবি:প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক রুহুল কবির আজাদ, সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মো: বেলাল হোসেন সরকার ও সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক এমদাদুর রহমান।

রিটন দে লিটন, চট্টগ্রাম: পূর্ব রেলের একাধিক খাতে বিএনপি-জামাতপন্থী কর্মকর্তারা  সরকারের শতকোটি টাকা লোপাট করলেও দেখে না দেখার ভান করছেন রেল মন্ত্রনালয় ও রেল ভবনে কর্মকর্তারা।

জোটসরকারের আমল থেকে রেলের টাকা লুটপাটে নেমেছেন এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। এমনই এক জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদনে।

জানা যায়, পূর্ব রেলের সরঞ্জামের কর্তাবাবুরা বিভিন্ন খাতে সরকারের কত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার হিসাব মিলাতে কষ্টসাধ্য হয়েছে নিরীক্ষা কর্মকর্তাদের। এর পরও কত কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে তার সঠিক অঙ্ক নিরীক্ষা কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে পারেনি। এ থেকেই অনুমান করা যায় দুর্নীতির সুনামি কতটা ভয়াবহ হয়েছে!

অডিট প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৮৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩৭ ফুট প্রস্থের এক কক্ষের টিনশেড ভবন মেরামতে টাকা খরচ করা হয়েছে ২ কোটি ৬২ লাখ ৭১ হাজার ৯৩৭ টাকা! ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট অফিসের আরঅ্যান্ডআই শাখার ওই টিনশেড ভবনের পূর্তকাজের জন্যই এত টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। ওই কাজের জন্য সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে ৫৪টি চুক্তিপত্রের মাধ্যমে পূর্তকাজের মালপত্র সরবরাহের বিপরীতে দু্ই কোটি ৬২ লাখ ৭১ হাজার ৯৩৭ টাকার বিল পরিশোধও করা হয়েছে।

নিরীক্ষা কর্মকর্তারা চুক্তিপত্র ও বিল ভাউচার বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, ওই কক্ষ মেরামতকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন অনেক দ্রব্য সরবরাহের জন্য চুক্তি করা হয়েছে। প্রতিটি দ্রব্য বাজারদরের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি ধরে প্রাক্কলন ও দাম পরিশোধ করা হয়েছে। ওই কক্ষের মেরামত কাজটি ওয়ার্কস-সংক্রান্ত হওয়ায় রেলওয়ের প্রটোকল অনুসারে ইঞ্জিনিয়ারিং কোডের ৯০১ এবং প্রকৌশল বিভাগ প্রণীত শিডিউল অব রেইট/২০১৩ অনুযায়ী দাপ্তরিক প্রাক্কলন তৈরি করে কাজ শেষ করার কথা ছিল।

কিন্তু! তা না করে ওয়ার্কস-সংক্রান্ত কাজ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে শেষ করা হয়েছে। পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে লাভবান হওয়ার জন্য এভাবে কাজটি করে সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা তছরুপ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

আলাদা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (চট্টগ্রাম) ছয় হাজার ৫০০ টাকা দামের এলইডি টানেল লাইট প্রতিটি ক্রয় করেছেন ২৭ হাজার ৭৪০ টাকা দরে। একটি ডুয়েল ক্লিপস এলইডি ফিটিং ল্যাম্পের প্রকৃত দাম ছয় হাজার ৫০ টাকা। তা কেনা হয়েছে প্রতিটি ১৪ হাজার ২৮৮ টাকায়। এলইডি টানেল লাইট ৯০টি এবং এলইডি ফিটিং ল্যাম্প কেনা হয়েছে ৫০টি। এই খাতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ২০ লাখ ৮৫ হাজার ৫৩২ টাকা।

রেলওয়ে সুত্রে জানা যায় গত কয়েকমাস পূর্বে পাহাড়তলী ষ্টোর ইনচার্জ নজরুল ঠিকাদারের সহায়তায় ষ্টোরে রক্ষিত বৈদ্যুতিক মালামাল নন্দনকানন ইলেট্রিক মার্কেটে বিক্রি করতে আসলে চোরাই মালামাল বিক্রি করার অপরাধে ইলেট্রনিক ব্যবসায়ি সমিতির সদস্যরা তাকে আটক করে সমিতির অফিসে নিয়ে যায়। সমিতির নেতারা রেলের চোরাই মালামালসহ নজরুলকে প্রশাসনে হাতে তুলে দিতে চাইলে রেলের ঠিকাদার রাসেল সমিতির নেতাদের হাতেপায়ে ধরে তার জিম্মায় নজরুলকে মুক্ত করে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক রুহুল কবির আজাদ, সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মো: বেলাল হোসেন সরকার ও সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক এমদাদুর রহমানসহ আরও কিছু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পূর্ব রেলের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন মেশিনারিজ মালপত্র, স্টোন ব্যালাস্ট, লিফটিং জ্যাক, রেল ড্রিলিং মেশিন ইত্যাদি বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে কেনায় রেলের আর্থিক ক্ষতি করেছেন ২ কোটি ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার ১৯৪ টাকা। বিভিন্ন মেশিনারিজ মালপত্র কিনে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৭৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯৪ টাকার। স্টোন ব্যালাস্ট কিনে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৬০ লাখ ১০০ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিটি লিফটিং জ্যাকের প্রকৃত বাজারদর ১৮ হাজার ৬৮৮ টাকা। এর প্রতিটি কেনা হয়েছে দুই লাখ ৯৯ হাজার ৭০০ টাকা দরে। এভাবে পাঁচটি লিফটিং জ্যাক কেনা হয়েছে। পূর্ব রেলের সিলিং ও এগজস্ট ফ্যান কিনে ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ৪৭০ টাকা লোপাট করা হয়েছে। প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে কেনা হয়েছে এই দুই ধরনের ফ্যান। সিলিং ফ্যান কেনা হয়েছে ১৭০টি। এগজস্ট ফ্যান কেনা হয়েছে ৬০টি। একটি সিলিং ফ্যানের প্রকৃত বাজারদর ছয় হাজার টাকা, তা কেনা হয়েছে ১৪ হাজার ৪৭০ টাকা দরে। একইভাবে একটি এগজস্ট ফ্যানের দাম বাজারে এক হাজার ২৫০ টাকা, তা কেনা হয়েছে আট হাজার ৪০০ টাকা দরে।

আরও জানা যায়, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক রুহুল কবির আজাদ ঠিকাদারীও করেন নামে/বেনামে,  আরও কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। দীর্ঘদিন রেল ভবনে তিনি এমন কাণ্ড করে আসলেও নিরব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, গত অর্থবছরে পূর্ব রেলে অতিরিক্ত দামে ৮১৬ কেজি গ্যাস কিনে আর্থিক ক্ষতি করেছে ১২ লাখ ৪১ হাজার ৫৬ টাকা। প্রতি কেজি ৭৩০ টাকা দামের গ্যাস কেনা হয়েছে দুই হাজার ৪৪৮ টাকা কেজি দরে। এভাবে মোট ৮১৬ কেজি গ্যাস কেনা হয়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১২ লাখ ৪১ হাজার ৫৬ টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে পূর্ব রেলের কোচের এসি মেরামতের জন্য বিভিন্ন মালপত্র কেনা হয়। এ ক্ষেত্রেও প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে মাল কেনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮৫ লাখ ৭৩ হাজার ৯০০ টাকা। তিনটি ফটোকপি মেশিন কিনতে গিয়েও দামের গরমিল করা হয়েছে। প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দরে কেনার কারণে ক্ষতি হয়েছে ছয় লাখ ৬৭ হাজার ৪৭৫ টাকা। প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি দামে কেনা হয় এই ফটোকপি মেশিনগুলো।

বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনা হয়েছে প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণ দামে। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে এক কোটি আট লাখ ২২ হাজার ৮১০ টাকা। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু সামগ্রী কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে কেনা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এ ব্যাপারে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, আপনার যা ইচ্ছে লিখে দেন, পূর্ব রেলে আমি এসেছি পাঁচ-ছয় মাস হলো, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে রেলে কেউও ভালো মানুষ নেই।

এ বিষয়ে জানার জন্য পূর্ব রেলের প্রধান সরঞ্জাম ণিয়ন্ত্রক রুহুল কবির আজাদ ও সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ বেলাল হোসেন সরকারের মোঠোফোনে একাদিক বার কল দেয়া হলেও এই কর্তাবাবুরা কল রিসিভ করেনি।