জাহাজ থেকেই চুরি হচ্ছে হাজার হাজার লিটার জ্বালানি তেল

প্রকাশঃ ২০১৯-০৪-১২ - ১৭:৫৫

ঢাকা অফিস : হাজার হাজার লিটার জ্বালানি তেল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তেলবাহী জাহাজ থেকেই চুরি হয়ে যাচ্ছে। আর ওই জ্বালানি তেল চুরির সাথে প্রভাবশালী চক্র জড়িত। তাছাড়া ডিপো কর্মকর্তা ও জাহাজের লোকজনের জড়িত তেল চুরির সাথে থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বছরের পর বছর ধরে তেলের চোরাকারবার চললেও কোনো প্রতিকার বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই নারায়ণগঞ্জে পদ্মা ও মেঘনা অয়েল কোম্পানির ডিপোতে শীতলক্ষ্যা নদীর বুকে নোঙ্গর করা তেলের জাহাজ থেকে চোরাকারবারিদের তেল চুরির মহোৎসব শুরু হয়। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। তেল চোরাকারবারিরা নদীর দুই পাড়ে অনেকগুলো অবৈধ দোকান গড়ে তুলেছে। চোরাই তেল ওসব দোকান হয়ে পাইকারি ও খুচরা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে যায়। ছোট দোকান, অয়েল ফিলিং স্টেশন, গাড়ির গ্যারেজ, বড় শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন জায়গাতেই ওই চোরাই তেল যায়। কিন্তু বিপিসি শুধু লোকসান গুনে। বিপিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদেশ থেকে আমদানি করা পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত তেল প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। সেখান থেকে ছোট জাহাজযোগে ঢাকা ও খুলনায় বিতরণ কোম্পানির ডিপোতে সরবরাহ করে বিপিসি। চট্টগ্রাম থেকে যে পরিমাণ তেল জাহাজে ভরা (লোড) হয়, একই পরিমাণ তেল জাহাজগুলোকে গন্তব্য ডিপোতে খালাস (আনলোড) করতে হয়। কিন্তু ডিপোর এক শ্রেণির কর্মকর্তা এবং জাহাজের লোকজনের যোগসাজশে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে পদ্মা ও মেঘনা অয়েল কোম্পানির ডিপোতে নিয়মিত তেল চুরি হচ্ছে। আর চুরি করা তেলে ওই এলাকায় গড়ে উঠেছে তেলের কালোবাজারি ব্যবসা। সম্প্রতি বিপিসির নিজস্ব তদন্ত দলও ওই তেল চুরির প্রমাণ পেয়েছে। ডেমরা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের বার্মাস্ট্যান্ডে গোদনাইলে রাস্তার দুপাশে নামে-বেনামে অসংখ্য ট্রেডিং সাইনবোর্ড সাটানো তেলের দোকান রয়েছে। ওসব ট্রেডার্সের অধিকাংশেরই পদ্মা কিংবা মেঘনা তেল কোম্পানির সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই। তেল কালোবাজারির সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচিত-অনির্বাচিত অনেক নেতা ও তাদের কর্মী-অনুসারীরা জড়িত। চাইলেও পুলিশ সবসময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না না। আবার বিপিসি বা পেট্রোলিয়াম ডিপোগুলোও এ ব্যাপারে তেমন অভিযোগ করে না।
সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে এমিউস মেরিন সার্ভিসের মালিকানাধীন জাহাজ এমটি আবু সাদিক সিদ্ধিরগঞ্জে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের (এমপিএল) ডিপোতে পৌঁছে। কিন্তু লোডিং পয়েন্টের তেলের পরিমাণ এবং আনলোডিং পয়েন্টের তেলের পরিমাণে ১৫ হাজার লিটারের গড়মিল পাওয়া যায়। মূলত চুরির কারণে ওই গরমিল হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বিপিসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত ১৪ মার্চ তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে চুরির সত্যতা পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে তেল চুরি প্রতিরোধে ১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের আহবান জানিয়েছে কমিটি। তেল চুরির সাথে জাহাজের সুপারভাইজার এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ডিপো ইনচার্জ জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে।
সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রাম থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে গোদনাইল বন্দরে এসে তেল খালাস হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কয়দিন জাহাজগুলো নদীতে অপেক্ষমাণ থাকে, প্রতিরাতেই ওসব জাহাজ থেকে তেল চুরি হয়। গোদনাইল দুই নম্বর গেটে জাহাজ থেকে সবচেয়ে বেশি তেল চুরি করে থাকে। জাহাজ থেকে তেল চুরির পর রাখা হয় নদীর তীরে ডিপোর পাশে টিনের শেডে তৈরি বিভিন্ন ঘরে। ওসব ঘরের জানালাগুলো বন্ধ রাখা হয়। পরে ওই তেল খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়। পদ্মা ও মেঘনার তেলের ডিপোর বিপরীতে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপাশে বন্দর থানার বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী দীর্ঘদিন ধরে তেল চুরির সঙ্গে জড়িত।
এদিকে বিপিসি সংশ্লিষ্টরা জানান, সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যার পাড়ে নামে-বেনামে জ্বালানি তেল সরবরাহ ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেয়েছে বিপিসির তদন্ত দল। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অবৈধ ট্রেডার্সগুলোকে উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে এখনো ওসব অবৈধ দোকানপাটগুলো উচ্ছেদ হয়নি। বরং বহাল-তবিয়তেই তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এমনকি তদন্তে যেসব চোরাকারবারির নাম এসেছে তারা এবং তাদের অনুসারীরা ডিপো এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান জানান, তেল চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত বলে যে নামগুলো এসেছে তাদের ব্যাপারে আরো তদন্ত করতে এবং তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য খতিয়ে দেখতে দুদককে অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের ডিসিকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।