দালাল আইন বাতিল করে ছেড়ে দেওয়া হয় যুদ্ধাপরাধীদের

প্রকাশঃ ২০১৯-১২-১২ - ১১:৩৪

ঢাকা অফিস : পাকিস্তানি দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে প্রনয়ণ করা হয় দালাল আইন। কিন্তু, পরবর্তীতে দালাল আইন বাতিল করে আসামিদের কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।
১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টের পর দেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে সবধরনের চেষ্টাই করেছিল তখনকার শাসকগোষ্ঠী। জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় দালাল আইন বাতিল করে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল ১০ হাজারেরও বেশি এদেশের পাকিস্তানী দোসরদের। এমনকি, পরেও যাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করা যায় তা নিশ্চিত করতে নষ্ট করা হয় বিভিন্ন আলামত।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী দেশে ফেরেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর দু’দিন পরই বঙ্গবন্ধু জানালেন পাকিস্তানের এদেশীয় দোসরদের বিচারের আওতায় আনা হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৪শে জানুয়ারি প্রণয়ন করা হয় দালাল আইন।

১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই আইনের আওতায় সারা দেশে ২৮৮৪টি মামলা হয়। আটক করা হয় ৩৭ হাজারের মত রাজাকার আলবদর আলশামসসহ পাকিস্তানের এদেশীয় দোসরদের। বিচারের জন্য গঠন করা হয় ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া, ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের বিচারের জন্য পাশ করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন।

এরপর, একটি কমিশন গঠন করে আটক দোসরদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই এমন ২৬ হাজার জনকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। তবে, শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, তাদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে বিচারের আওতায় আনা হবে। আর খুন, ধর্ষণ, দস্যুবৃত্তি, অগ্নিসংযোগ, অপহরণের মতো বেশ কিছু গুরুতর অপরাধে বাকিদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এর মধ্যে, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় ৭৫২ জনের।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থার প্রধান আব্দুল হান্নান খান বলেন, ‘অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরপরই যে বিচার শুরু হয়েছিল সেখানে সর্বোচ্চ সাজা একজনই পেয়েছিল কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে সে রায় টেকেনি।’ দালাল আইনের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে হান্নান খান বলেন, ‘কোনো মামলা সিআরপিসি হলেই তা সাধারণ মামলা হয়ে যায়। কিন্তু, যারা যুদ্ধাপরাধী তারাতো সাধারণ অপরাধী নয়।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়ার তত্ত্বাবধানে বাতিল করে দেয়া হয় দালাল আইন। মুক্ত করে দেয়া হয় কারাগারে থাকা ১১ হাজারের মত যুদ্ধাপরাধীকে।

মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. (অব.) এম হারুন অর রশীদ বীরপ্রতীক বলেন, ‘একটা জেলখানায় হাজার বছরের ইতিহাস সংরক্ষিত আছে। কারা জেলে আসছে, কবে আসছে এবং কি অপরাধে তারা জেলে এসেছে সব নথি আছে। শুধুমাত্র একাত্তর পরবর্তী সময় ১৯৭২, ৭৩, ৭৪ এবং ১৯৭৫ সালে যারা জেলে গেল তাদের নাম-নথি সংরক্ষণ করা নেই। এ সময়টিতে, বিভিন্ন থানায় যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোরও কোনো নথি নেই। যাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে বা সাজা হয়েছে তার দলিল থাকবে না কেন? আর এসব দলিল না থাকার অর্থ হলো এসব নথিপত্র ধ্বংস করা হয়েছে।’

তবে, এতকিছু করেও পার পায়নি যুদ্ধাপরাধীরা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায় এসে গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারের মুখোমুখি করা হয় নেতৃস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের।

এ পর্যন্ত, ট্রাইব্যুনালে হওয়া ১০৪টি মামলার মধ্যে রায় হয়েছে ৪১টির। এসব রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে ৬৮ জনকে। আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ২৫ জনকে। আপিলের রায়ের পর এখন পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকর হয়েছে ৬ যুদ্ধাপরাধীর।

সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান জানান, পৃথিবীতে আমাদের দেশ ছাড়া অন্য কোথাও নিজস্ব আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে গৌরবের অধিকারী।

তবে, ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা না বাড়ালে এবং সাক্ষী নিরাপত্তা আইন করা না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ব্যহত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।