নাটকীয়তায় ভরা এরশাদের রাজনৈতিক জীবন

প্রকাশঃ ২০১৯-০৭-১৪ - ১১:৩৯

ঢাকা অফিস : রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। গণআন্দোলনের মুখে টানা নয় বছরের শাসনের অবসান। নব্বই পরবর্তী গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও প্রতিষ্ঠিত।  উত্থান, পতন ও পুনরুত্থানের এই অবিশ্বাস্য হিসাব মিলিয়ে ইতিহাসে বিরল স্থান করে নিয়েছেন সাবেক সেনাশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

বিশ্বের ইতিহাসে পতিত স্বৈরাচারী হিসেবে রাজনীতিতে একমাত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে আছেন সাবেক এই সেনাশাসক।

ঊনিশশো ত্রিশে পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে জন্ম এরশাদের। দেশভাগের সময় পরিবারের সঙ্গে রংপুরে এসে স্থায়ী হন।

উনিশশো পঞ্চাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন। এর দু’বছরের মাথায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ ছুটিতে পূর্ব পাকিস্তানে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। ছুটি শেষে ফিরে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। তিহাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আটাত্তরে সেনাপ্রধান হন এরশাদ।

ঊনিশশো একাশিতে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া নিহত হওয়ার পর থেকেই রাজনীতির প্রতি প্রকাশ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেন এরশাদ। ঊনিশশো বিরাশি সালের চব্বিশে মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করেন। পরের বছরের শেষ দিকে আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ।

তিরাশিতে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলে দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের ওপর দমন-পীড়ন চালায় পুলিশ। সারাদেশে ছাত্রদের মধ্যে তীব্র হতে থাকে এরশাদবিরোধী মনোভাব।

ছিয়াশির পহেলা জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করে মে মাসে সাধারণ নির্বাচন দেন এরশাদ। এই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির মধ্যদিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তার দল। পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে সংসদ ডেকে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী এনে সামরিক শাসনের বৈধতা নিশ্চিত করেন এরশাদ, যা দুহাজার দশে অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত।

নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে সাতাশি সাল হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। ওই বছরের দশই নভেম্বর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামজোট এক হয়ে ঢাকা অবরোধ করে। এই কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত নূর হোসেন  স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলেনর প্রেরণা হয়ে উঠেন।  অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন।

তৃতীয় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হন জেনারেল এরশাদ। আটাশি সালের তেসরা মার্চ নতুন নির্বাচন দিলেও তা বজর্ন করে প্রধান বিরোধীদলগুলো।  বিতর্কিত এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এরশাদ আবার মসনদে বসলেও স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন চলতে থাকে।

সারাদেশে গণআন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায়ে নব্বইয়ের সাতাশে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডাক্তার শামসুল আলম মিলনকে হত্যা করা হয় সরকারি বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায়। এরপর স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চার হয়। সেরাতেই জরুরী অবস্থা জারি করেন এরশাদ। পরদিন সকালেই তা অমান্য করে রাজপথে নামে ছাত্র-জনতা।  আন্দোলনরে তীব্রতার মধ্যে এরশাদের ওপর থেকে সমর্থন গুটিয়ে নিতে থাকে সেনাবাহিনী। ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ছয়ই ডিসেম্বর কার্যকর করেন এরশাদ।

একানব্বইয়ে গ্রেপ্তার হন জেনারেল এরশাদ। কারাগারে থেকে পঞ্চম ও সপ্তম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পাঁচটি আসন থেকে জয়ী হন সাবেক এই স্বৈরাচার। ছয় বছর জেলে থাকার পর সাতানব্বইয়ের নয়ই জানুয়ারি জামিনে মুক্ত হন তিনি। তবে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় সপ্তম সংসদে তার আসন বাতিল হয়ে যায়। অস্টম সংসদে নির্বাচনের যোগ্যতা হারান। এর আগে তিনি বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হন।

নবম সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদ আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোটে যুক্ত হন। দশম সংসদ নির্বাচনের পর তিনি মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত নিযুক্ত হন। একাদশ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হন পতিত এই স্বৈরাচার।