ভরা শীতে একটু উষ্ণতা

প্রকাশঃ ২০১৮-০১-১৩ - ১৬:৫৪

রাবি প্রতিনিধি: রাবেয়া বেগম। বয়স আশির ওপরে। থাকেন একটি বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধ এ মাকে দেখার সময় নেই তাঁর দুই ছেলের! নিজেদের নিয়েই তারা ব্যস্ত। ছেলের বউরাও ‘বোঝা’ ভাবে শাশুড়িকে! জীবনের এ পড়ন্ত বেলায় এসে একেবারে একা হয়ে পড়েছিলেন রাবেয়া বেগম। অবশেষে ঠিকানা মেলে ঝিনাইদহের পাগলাকানায় সড়কের বটতলা সংলগ্ন বৃদ্ধাশ্রম রহমা সেন্টারে।

এমন অসহায় ১১ নারীর মুখে এক চিলতে হাসির পরশ বিলিয়ে দিতে শুক্রবার বিকেলে বৃদ্ধাশ্রমে হাজির হন জেলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ওদের জন্য’র তরুণ সদস্যরা। অসহায় মানুষগুলোর সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য তারা মেতে উঠেন গল্প-আড্ডায়।

এক পর্যায়ে তাদের কথা হয় রাবেয়া বেগমের সঙ্গে। এ সময় জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার কথা জানান রাবেয়া বেগম। বলতে গিয়ে গলা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো তাঁর। তাঁর ভাষায়, ‘বিটার বউরা ভালো চোহে দেহে না রে বাপ। ছেলেরাও যার যার মত মহা ব্যস্ত। কী করবো? এই জন্যিই এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসিচি। ভালো আচি এখেনে।’

পাশেই বসেছিলেন মধ্যবয়সী সাফিয়া বেগম। একটি দূর্ঘটনা তার জীবনের গল্পকেই ঘুরিয়ে দেয়। এক পা অচল। তবুও মুখে কিছু বলেন না। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দেনÑজীবন কতোটা বিচিত্র! এমন অজ¯্র বিচিত্র গল্পের সঙ্গী হয়ে গেলেন ‘ওদের জন্য’ ফাউন্ডেশনের সদস্য আয়শা সিদ্দিকা হুমায়রা, ডিকে উৎস বিশ্বাস, প্রেরণা করিম, সামিয়া রহমান স্বর্ণ, খালিদ হাসান, নাহিদ মল্লিক, নাসরিন সুলতানা রাহি ও আল-আমিন।

তাদের পদচারণায় পৃথিবীর চরম নির্মমতাগুলো যেন দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিলো অসহায় মানুষগুলোর পানে তাকিয়ে। কিছুটা সময়ের জন্য রহমা সেন্টারের রূপটাই বদলে যায়। ফাউন্ডেশনের তরুণ সদস্যদের সঙ্গে অসহায় মুখগুলোও হাসি-আনন্দে মেতে ওঠে।

গল্প আড্ডার পাশাপাশি সেখানে কেক কাটা হয়। পরে তাঁদের জন্য নাস্তা আর খাবারের আয়োজনও করে। তাঁদের হাতে তুলে দেয় একটি করে মেরিল ক্রিম। শীতে সুরক্ষার জন্যই এটি তাদেরকে দেওয়া হয়েছে বলে জানান ফাউন্ডেশনের সদস্যরা।

ভিন্নধর্মী এই আয়োজন সম্পর্কে সংগঠনটির আহ্বায়ক ফারিহা রহমান মিশু বলেন, বৃদ্ধাশ্রম এমন একটি জায়গা যেখানে সেই সকল বাবা-মায়েরা থাকেন, যারা ঘরছাড়া হন আপনজনদের অবহেলার স্বীকার হয়ে। একজন বৃদ্ধ মানুষের যতœ নিতে হয় নবজাতকের মতো। কিন্তু শেষ বয়সে ঘরছাড়া হওয়া মা-বাবারা ঠাঁই নেন বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে তাদেরকে যতোই যতেœ রাখা হোক না কেন তা পরিবারের বিকল্প হতে পারে না।

সবমিলিয়ে সবাই সিদ্ধান্ত নিই কোনো বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার। অসহায় কিছু মানুষের সাথে কিছু সময় কাটানোর। তাদেরকেও একটু হলেও ভালো সময় উপহার দেওয়ার। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্যই ‘ওদের জন্য’ ফাউন্ডেশন বলে জানান মিশু।

বিকেলের এ আয়োজন খুব জমকালো ছিলো তা নয়। তবে ছোট্ট পরিসরে তাদের এ উদ্যোগ পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছিল চারদিকে। রহমা সেন্টারের সামনের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ঠিকরে পড়ছিল শীতের মিষ্টি রোদের আভা। যে আভায় মলিন হয়ে আসে অসহায় মানুষের বুকে জমা কষ্টের বরফ। এ যেন ভরা শীতে একটু উষ্ণতা। আর এ মানুষগুলোর হাসি যেন শীতের উষ্ণতা দিচ্ছিল তরুণদের মনে। পরমাত্মাকে কাছে পেয়ে মেতে উঠেছিল কিছু জীবাত্মা। যে জীবাত্মার পানে চেয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ধ্বংস হয়ে যাক সকল বৃদ্ধাশ্রম।