মাদকে ঝুঁকছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা!

প্রকাশঃ ২০১৮-০৪-১৭ - ১০:৫৭

প্রতিরোধে ৬৫০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন

কামরুল হোসেন মনি : নগরীর সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নেশার করার টাকা জোগাড় করতে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী ওই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে মারধর করে কানের দুল ছিনিয়ে নেয়। ২০১৪ সালের ৩০ আগস্ট এই ঘটনায় অভিভাবকরা ওই সময় জেলাপ্রশাসকের কাছে সুষ্ঠু বিচারের দাবি তোলেন। বিষয়টি থানা পর্যন্ত গড়ায়, মামলাও হয়। এ ঘটনার পর বিষয়টি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে স্কুলের শিক্ষার্থীরাও মাদকে ঝুঁকে পড়েছে। শুধু ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয় নগরীর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রাইমারি স্কুলে ছাত্ররাও মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিধ্বংসকারী মাদকের বিস্তার সমাজে যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে সচেতন অভিভাবকমহল উদ্বিগ্ন। আসক্ত হওয়ায় তাদের অভিভাবকরা গোপনে ছেলে-মেয়েকে মাদক নিরাময় চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা করাচ্ছেন।
এদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকের বিষয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি গঠনে নির্দেশ প্রদান করেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের খুলনাঞ্চলের উপ-পরিচালক নিভারানী পাঠক সার্বিক বিষয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রথমে দরকার মোটিভেশন। শিক্ষার্থীদের শুধু লেখাপড়া না, লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক এই সব দিকে তাদেরকে একটু ব্যস্ত রাখা। সেটা হতে হবে পরিচ্ছন্ন, নিরপক্ষে এবং সিস্টেম অনুযায়ী। এলোমেলোভাবে করলে হবে না। শিক্ষার্থীদের শুধু মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক বিষয় তুলে ধরলে হবে না, তাদেরকে বিভিন্ন বিনোদনমূলক কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক বিভিন্ন বিষয় প্রতি বৃহস্পতিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদেরকে তুলে ধরা হয়। এটি প্রতিনিয়ত হয় কি না তারও মনিটরিংয়ের প্রয়োজন আছে।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় এর উপ-পরিচালক মোঃ রাশেদুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, মহানগরীসহ খুলনা জেলা ও উপজেলাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্কুলে ৪০৬টি, কলেজ ৭৮টি, মাদ্রাসা ১২৮টি, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৯টি ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৯টি মোট ৬৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে প্রধান করে ৫ সদস্য কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই সব কমিটি মাদকবিরোধী জনসচেতনতামূলক সভা করে শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদকের কুফল সম্পর্ক তুলে ধরবেন।
এ ব্যাপারে খুলনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ আরিফুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, মাদক প্রতিরোধসংক্রান্ত কমিটিতে তাকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর কমিটিতে দুই শিফটের একজন করে দুইজন শিক্ষক ও দুইজন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এদেরকে নিয়ে প্রতি মাসে ও সপ্তাহে মাদক প্রতিরোধমূলক সভায় পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা করা হয়। তিনি বলেন, শুধু শিক্ষকদের ওপর ছেলে-মেয়েকে ছেড়ে দিলে হবে না অভিভাবকদেরও তাদের ছেলে-মেয়েদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেন।
জেলা শিক্ষা অফিসার খোঃ রুহুল আমীন সোমবার এ প্রতিবেদককে বলেন, জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের নির্দেশনানুযায়ী মাধ্যমিক স্কুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাদকবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের কমিটির সদস্য মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও তা শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরবেন। এ সংক্রান্ত প্রতিমাসে প্রতিবেদন তৈরি করে সংরক্ষণে রাখতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। কৌতূহল, পারিবারিক অশান্তি, বন্ধুদের কুপ্ররোচনা, অসৎ সঙ্গ, নানা রকম হতাশা ও আকাশ-সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার মূল কারণ। জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এর হার বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। অতীতে মাদকের সাথে ছেলেদের সম্পৃক্ততা বেশি পরিলক্ষিত হলেও বর্তমানে গত কয়েক বছরে মাদক সেবনের মতো একটি আত্মঘাতী নেশার ছোবল থেকে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেয়ে শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে নেই। নগরীর বেসরকারিভাবে পরিচালিত মাদক নিরাময় চিকিৎসাকেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে মাদকাসক্তের একটি অংশ স্কুলের শিক্ষার্থীরা। প্রাইমারীতে পড়–য়া তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্র মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। এ রকম প্রায় ১৫-২০ জনকে এ সেবা দেওয়া হয়েছে।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় সূত্র মতে, প্রতিদিন কোন না কোন জায়গায় মাদক বিক্রেতাদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গত মার্চ মাসে খুলনা জেলায় ৬৩টি অভিযান পরিচালনা করেন। এর মধ্যে রুজুকৃত নিয়মিত মামলার সংখ্যা ১২টি ও মোবাইল কোর্ট ৭টি। এছাড়া নিয়মিত আসামির সংখ্যা ১৫টি ও ৭টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এছাড়া গোয়েন্দা বিভাগে নিয়মিত মামলা ৪টি ও ৫টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এই সময়ের মধ্যে গাঁজা ১ কেজি ৯৫০ গ্রাম, গাঁজা গাছ একটি, চোলাই মদ ২০ লিটার, বিদেশি মদ ৭ বোতল, বিয়ার ৬৫ ক্যান, ফেন্সিডিল ১৩ বোতল, ইয়াবা ৪০০ পিস ও মাদক বিক্রির ৪০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় এর প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত) পারভীন আক্তার বলেন, যারা মাদকসহ আটক হচ্ছেন তারা আইনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে আবার জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় মাদক বিক্রি করছেন। যার কারণে একদিকে অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে ধরা হচ্ছে, অন্যাদিকে আইনের মারপ্যাঁচে তারা বেরিয়ে আসছেন। তিনি মাদক বিক্রেতারা যাতে সহজেই জামিনে বেরিয়ে আসতে না পারেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।