একজন মুক্তিযোদ্ধার কাদির মিয়া জীবদ্দশায় কি গেজেট ভূক্ত হবেন?

প্রকাশঃ ২০১৯-০৩-০৯ - ১৯:১৮

নিজস্ব প্রতিবেদক : ৭১এর সূর্যসন্তান মো: আব্দুল কাদির মিয়া, বয়স ৬৮ কোঠায়। ঢাকা লৌহজং এলাকার বাসিন্দা। পিতা মৃত: হাফিজ উদ্দিন মিয়া, মাতা মৃত: জামিলা খাতুন। হাফিজ উদ্দিন মিয়া ৬ সন্তানের জনক। দুই ছেলে ও চার মেয়ে। বড় ছেলে আব্দুল কাদির ও মেয়ে নাছিমাকে নিয়ে লৌহজং থানার খড়িয়া গ্রামে বসবাস করতেন এবং স্থানীয় কুমারভোগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করতেন। আব্দুল কাদির মিয়া একপর্যায়ে ৬৪ সালের ৪ এপ্রিল পিতা হাফিজ উদ্দিন মিয়ার হাত ধরে খুলনায় চলে আসেন এবং এখানে আসার পর তৃতীয় শ্রেণী থেকে পড়া শুরু করেন খুলনা রেলওয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হবার আগেই পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন খুলনা জিলা স্কুলে। সেখানে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারা সুন্দর ভাবে জীবন চালাতে থাকে। সেই সময় দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন খুলনাতে মুক্তিযুদ্ধের লড়াই শুরু হলে পিতা হাফিজুদ্দিন মিয়ার হাত ধরে স্বপরিবারে সাবেক ঢাকা জেলার লোহজংয়ের খডিয়া গ্রামে ফিরে যান। কিন্তু পাকবাহিনীর বরবর অত্যাচার আর মুখবুঝে সহ্য না করতে পেরে পিতা মাতার চোখ ফাকি দিয়ে তিনি চলে আসেন খুলনাতে খুলনা মহানগরীর আজকের রয়েল মোড় স্থানটি তখন পরিচিত ছিল অনন্ত মল্লিকের মাঠ নামে। আর তখন এই মাঠে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের প্রধান ছিলেন নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা ল্যাফ্টান্যান্ট মফিজুর রহমান। এখানে কাদির মিয়া প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। এক পর্যায় দেশে যখন লাশের মিছিল শুরু হয়, তখন কাদির মিয়াসহ ১৯ জন স্বাধীনতা গামী বীরের সাথে রওনা দেন ফরিদপুর। তারা ফরিদপুর নারকেল বাড়িয়া মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাদির মিয়াসহ ১৯জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে পৌছাঁন। ফরিদপুর হেড কোয়াটারে দায়িত্বরত সাব-সেক্টর কমান্ডার নূর মোহম্মদ বাবুল ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেন। একপর্যায়ে আরও প্রশিক্ষনের জন্য তাদেরকে ভারতে না পাঠিয়ে হিজলবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থিত ক্যাম্পের নায়েক আ: খালেকের কাছে পাঠানো হয়। খালেকের নেতৃত্বে চলতে থাকে দেশকে রক্ষা করার প্রশিক্ষণ। ইতোমধ্যে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানাধীন ঘাগর বাজার এলাকায় অবস্থানরত ইপিআর ও রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে অনুযায়ী নায়েক আব্দুল খালেকের নেতৃত্বে ঘাগর বাজার দূরবর্তী একটি নারিকেল বাগানে অবস্থান নিয়েছিলে আব্দুল কাদির সহ তার সহযোদ্ধারা। স্মৃতি চারন করতে গিয়ে কাদির মিয় বলেন, রাত ৪টা ১ মিনিটের সময় ইপিআর ও রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে নায়েক আব্দুল খালেকের সহিত একত্রিত হন সাব-সেক্টর কমান্ডার নূর মো: বাবুল ও ৭১ এর হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন এর নেতৃত্বে যৌথভাবে ইপিআর ও রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে একত্রিত ভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। উভয়ের মধ্যে ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পনের কথা বলা হয় কিন্তু তারা প্রথমে আত্মসমর্পন না করলেও পরবর্তীতে আত্মসমর্পন করে। সেখানকার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার পরে আমরা জানতে পারি যে, কুলপাড়া নামক গ্রামে পাকবাহিনী হানা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা দেরি না করে কুলপাড়া গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করি। কিন্তু তারা আর আসেনি। ইতোমধ্যে দেশ হয় স্বাধীন। মুক্তিযোদ্ধা আ: কাদির মিয়া আরোও বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবুল বাহিনীর অধীনে মুক্তিযোদ্ধারা ফরিদপুর চানমারি আনসার ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই ক্যাম্প থেকে রক্ষীবাহিনীতে যোগদানের উদ্যেশ্যে প্রশিক্ষন নিতে থাকি। পরে আমি ১৯৭২ সালের ১৮ জুলাই ফরিদপুর হেড কোয়াটারে দায়িত্বরত সাব-সেক্টর কমান্ডার নূর মোহাম্মদ বাবুল এর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ সনদ সংগ্রহ শেষে খুলনাতে ফিরে আসি। আর এখানে আসার পর হারিয়ে ফেলি আমি আমার মুক্তিযোদ্ধা সনদ। এভাবে একের পর এক জীবন যুদ্ধে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। এক পর্যায়ে বাবা মারা যান। তখন সংসারে সব চাপ আমার উপর আসে। এভাবে চলতে থাকে জীবন কিন্তু তার মধ্যে থেকে আমি খুজতে থাকি আমার কমান্ডার নূর মোহাম্মদ বাবুল ভাইকে। এক পর্যায়ে বাবুল ভাইকে পাই ও তার মাধ্যমে জানতে পারি হেমায়েত সাহেবের সন্তান সবার সহিত যোগাযোগ করে ফিরে পাই আমার মুক্তিযোদ্ধা সনদ। কিন্তু ২০০৯ সালে বাদপরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভূক্ত করার ঘোষনা দেওয়ার পর আমি ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ডার কাউন্সিলের আহ্বায়ক বরাবর আবেদনপত্র পাঠাই, সেখানে কোন সাড়া না পেয়ে পুনরায় ২০১০ সালের ১৩ অক্টোবর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ডিজি বরাবর ও আবেদন করেন আব্দুল কাদির, যাহার ক্রমিক নং ১০৮৫। এতেও কোন সাড়া না মেলায় ৮ মে ২০১৩ সালে আরো একটি আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ডিজি বরাবর, যাহার ক্রমিক নং-১১৬৮৩। কিন্তু রণাঙ্গনের এই বীরমুক্তিযোদ্ধা হয়নি তালিকাভুক্ত। আজ অবদি পায়নি সরকারী ভাতাসহ অন্যান্য সরকারী সুযোগ সুবিধা। বর্তমানে এই বীমুক্তিযোদ্ধা মানবেতর জীবনযাপন করছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। তাই অতি দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে যে ৭১ এর সূর্য সন্তান আব্দুল কাদির মিয়ার মত সাহসী যোদ্ধাদের অসীম সাহসের কারনে আমরা আজ পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আব্দুল কাদির মিয়া স্থান মেলেনি সরকারী গেজেটে। তাই প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করেছেন রণাঙ্গনে জীবন বাজী রাখা অংশ নেওয়া এই বীরমুক্তিযোদ্ধার এই পরিবারটি। বীমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদির মিয়া কি তার জীবন দশায় দেখে যেতে পারবেন তার নামটি গেজেটভূক্ত হয়েছে?