হুমকির মুখে সুন্দরবন : একাধিক চোরাকারবারী চক্র সক্রিয়

প্রকাশঃ ২০১৯-১২-০৭ - ১২:৩৬

ইমতিয়াজ উদ্দিন, কয়রা : কয়রা উপজেলার দক্ষিন বেদকাশী মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় ইটের সলিং রাস্তার উপর খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে হরিণের মাংস। প্রতি কেজি মাংসের মূল্য পাঁচশত টাকা। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তাৎক্ষনিক ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দেন কয়রার কাটকাটা পুলিশ ক্যাম্পের এসআই মোঃ হাফিজুর রহমান। উল্লেখিত স্থানে হাজির হয়ে দেখেন- ১০/১২ জন লোকের একটি জটলা। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে যে যার মতো মাংস নিয়ে দেয় দৌড়। পুলিশ ধরতে পারে মাত্র ২ চোরাকারবারিকে। তাদের নিকট থেকে উদ্ধার হয় সাদা রঙের প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতরে পলিথিনে মোড়ানো ২ কেজি হরিণের মাংশ। বাকি মাংসের হদিস আর মেলেনি। ঘটনাটি গত ২৯ নভেম্বরের। কিভাবে হরিণের মাংস এল এবং এই ব্যবসায় কারা কারা যুক্ত আছে সে বিষয়ে তদন্তও শুরু করেছে পুলিশ।

উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের কুশোডাঙ্গা এলাকার আব্দুর সাত্তার সানার পুকুরে পাচার করার উদ্দেশ্যে সুন্দরবন থেকে কেটে আনা কয়েকটি সুন্দরী গাছ রাখা হয়েছে। গত ২৬ অক্টোবর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিষয়টি জানতে পানের কয়রা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ নুর-ই আলম সিদ্দিকী। রাত ১০ টার দিকে সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে হানা দেন তিনি। এ সময় পুকুর থেকে কর্তন নিষিদ্ধ ৫ পিচ সুন্দরী গাছ উদ্ধার করা হয় এবং ওই কাঠের মালিক আবুল হাসেম কে আটক করে ছয় মাসের কারাদন্ড প্রদান করে ভ্রাম্যমান আদাল।

গত ৭ আগস্টও ৮ কেজি হরিণের মাংস সহ পুলিশের হাতে আটক হয় মিঠুন হালদার নামে এক পাচার কারী। মিঠুন উপজেলার দক্ষিন বেদকাশি গ্রামের বাসিন্দা। এসময় তার সাথে থাকা বাকিরা পালিয়ে যায়। এছাড়া এর আগে উপজেলার ৪নং কয়রার এলাকা থেকে ২৫ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার হয়। তার অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে উপজেলার শাকবাড়িয়া আংটিহারা এলাকা থেকেও ১৪ কেজি হরিণের মাংসসহ এক যুবককে আটক করেছিল কোস্টগার্ড। এরপরই দক্ষিণ বেদকাশির সুন্দরবন সংলগ্ন জোড়শিং এলাকার বেড়িবাঁধ থেকে ২০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করে পুলিশ। তখন হুমায়ুন কবির হুদা ও খোকন নামে ২ চোরাকারবারীকে আটক করে পুলিশ।

সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলা থেকে প্রায়ই আটক হচ্ছে হরিণের মাংসসহ শিকারী আর সুন্দরবনের কাঠ পাচারকারী। চোরাকারবারিদের প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি সত্তেও বন্ধ হচ্ছে না তাদের তৎপরতা। সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র সুন্দরবন এলাকায় মাছ ধরার পাশ-পারমিট নিয়ে হরিণ শিকারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শুধু হরিণ শিকারই নয় সুন্দরবন থেকে গাছও পাচার করছে এসব চোরাকারবারিরা। আসন্ন মৌসুমে সুন্দরবনে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পারশে পোনা আহরণে প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে চক্রটি। এরই মধ্যে তারা বিলাসবহুল ও দ্রুতগতির কয়েকটি ট্রলার তৈরি করেছে। নিরাপদ রুট দিয়ে নিষিদ্ধ পারসে পোনা আনা-নেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকেও ম্যানেজ করতে ততপর হয়েছে চক্রের সদস্যরা।

তবে অনুসন্ধানে জানাযায়, এই চক্রের মূল হোতা কয়রার বনদস্যুদের এজেন্ট খ্যাত কয়েকটি কোম্পানি সিন্ডিকেট। শুধু মাছ ব্যবসার লাভ গুনে সন্তুষ্ট নন এব্যবসায়ীরা। ফলে সুন্দবণের অমূল্য সম্পদ হরিণের মাংস বিক্রিকেও বড় ধরনের লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত করতে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিয়েছেন অবৈধ ব্যবসায়ীরা। বেশ কয়েকটি হরিণ শিকারীর দলও চালাচ্ছেন এই মাছ ব্যবসায়ীরা। গত ১৫ অক্টোবর সুন্দরবনে র‌্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে ৪ বনদস্যু নিহত আর কয়রা উপজেলার ২জন বনদস্যুর পৃষ্ঠপোষক কম্পানি মহাজন আটক হয় র‌্যাবের জালে।এর পর দির্ঘদিন আত্মগোপনে ছিল কোম্পানি সিন্ডিকেটের মূল হোতারা। সম্প্রতি তারা পারশে মাছের পোনা আহরনের জন্য আবারও সক্রিয় হয়েছে। প্রতিবছর এই সিজোনে পারসে মাছের পোনা আহরন থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করে পোনা নিধনকারীরা।

তবে বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানে মাঝে মধ্যে চোরাকারবারীরা পাকড়াও হলেও অপরাধের মাত্রা না কমায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে এলাকার মানুষের মোনে।অপরদিকে কম সংখ্যক বনরক্ষী, নামমাত্র অস্ত্রশস্ত্র ও দ্রুতগামী নৌযানের অভাবের কারনে সুন্দরবন রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে বন বিভাগ সদস্যরাও।

বন বিভাগ খুলনা সার্কেলের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব ও পশ্চিম সুন্দরবন মিলে ৪টি রেঞ্জ অফিস, ১৬টি ফরেষ্ট ষ্টেশন, ৫৬টি টহল ফাঁড়ি রয়েছে। এ সকল ফরেষ্ট ষ্টেশন ও টহল ফাঁড়িতে ফরেষ্ট রেঞ্জার, ডেপুটি রেঞ্জর, ফরেষ্টার, বনপ্রহরী ও নৌকা চালকের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় রয়েছে কম। পশ্চিম বন বিভাগের আওতায় কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া, বজবজা, খাসিটানা, আন্দারমানিক, গেওয়াখালি টহল ফাঁড়িতে প্রয়জন অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র নেই। ইঞ্জিনচালিত ট্রলার থাকলেও কোন ষ্টেশন ও ফাঁড়িতে নেই স্পীডবোট। চোরাকারবারীদের খবর পেয়েও দ্রুতগামী নৌযানের অভাবে অনেক সময় তাদেরকে ধরা সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন টহল ফাঁড়িতে কর্মরত বনরক্ষীরা।

স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন এইএলাকায় গড়ে উঠেছে কাঠ পাচার ও হরিণ শিকারীদের একাধীক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। কাঠ পাচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সুন্দরবন থেকে কাঠ সংগ্রহকরে লোকালয়ের বিভিন্ন জায়গায় এনে বিক্রয় করে থাকে এ সিন্ডিকেট। স্থানীয় এক শ্রেণীর চোরাকারবারিরা বন থেকে কাঠ কেটে ট্রলারযোগে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, চন্ডিপুর ও পদ্মপুকুর এলাকায় নিয়ে উচ্চ মূল্যে এসব কাঠ বিক্রি করে। আর হরিণ শিকারীচক্রের শক্ত অবস্থান রয়েছে কয়রার সুন্দরবন সংলগ্ন জোড়শিং, পাথরখালি, ৪নং কয়রা, হায়াতখালি, তেতুলতলাচর, খোড়লকাটি, কালিবাড়ি, হড্ডা ও দক্ষিণ বেদকাশী এলাকায়। চোরা শিকারী চক্র সুন্দরবনে ঢুকে ছিটিকল ও ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে এবং এদের সাথে থাকে এজেন্ট ব্যবসায়ীরা। এসব এজেন্টের মাধ্যমে কখনও অগ্রীম অর্ডার আবার কখনও মাংশ এনে তার পর বিক্রি করা হয়।মূলত বন বিভাগের বিভিন্ন স্টেশন থেকে মৎস্য আহরণের পাস নিয়ে শিকারীচক্র বনের মধ্যে প্রবেশ করে থাকে তারা।

সুন্দরবনের উপর নির্ভরশিল কয়রা সদরের পল্লিমঙ্গল এলাকার জেলে আবু মুসা জানান, সুন্দরবনে নিষিদ্ধ এলাকার মাছ ধরার সব ঘাটগুলো বর্তমানে দখলে আছে কয়রার কয়েকজন মাছ কোম্পানির মহাজনের। তাদের অনুমতি ছাড়া সুন্দরবনের খালে ঢোকা সম্ভব নয়। সুন্দরবনের অভারণ্য এলাকার খালগুলোর নিয়ন্ত্রণ করে তারা। ওনসব খালে অহরহ বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হয় বলে তিনি জানান।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, বারবার একই অপরাধে আটক হওয়ার পরেও স্বল্পমেয়াদি সাজা ভোগের পর আইনের ফাকফোকড় দিয়ে বেরিয়ে যায় চিহ্নিত অপরাধিরা । মুক্তি পেয়ে পুনরায় হরিণ শিকার আর কাঠ পাচারের মতো লাভজনক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে কয়রা উপজেলার সংঘবদ্ধ এ চক্রটি।

সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের বাসিন্দা কয়রা সদর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান সরদার নাজমুস ছায়াদাত জানান, চোরাকারবারী চক্র সুন্দরবন থেকে হরিণ মেরে লোকালয়ে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে তা গোপনে কেজি দরে বিক্রি করে। ক্রেতাদের সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ হয় তাদের। এছাড়া বনবিভাগের কতিপয় অসাধু সদস্যদের সাথেও তাদের যোগাযোগ থাকে।

বন সংলগ্ন এলাকার লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চোরাকারবারী এ চক্রের সদস্যরা সুন্দরবনের বিভিন্ন স্টেশন থেকে জেলে পরিচয়ে সাদা মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনের গহীনে অভয়ারাণ্যগুলোয় প্রবেশ করে। এরপর তারা মাছ ধরার পাশাপাশি কাঠ ও বন্যপ্রাণী পাচার করে। মাঝে মধ্যে যে দু’একটি আটকের ঘটনা ঘটে তা কেবল মাত্র লোক দেখানো। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার প্রশাসন বা বন বিভাগের সাথে বনিবনা না হওয়াতে আটক করা হলেও অধিকাংশ সময় ধারা পড়ে না সুন্দরবনে চোরাকারবারীর সাথে জড়িত মূল চক্র।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কয়রা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ রবিউল হোসেনের বলেন, হরিণ শিকার ও পাচার রোধে তারা সব সময় সতর্ক রয়েছে। ইতপূর্বে বিভিন্ন সময় তারা অভিযান চালিয়ে হরিণের মাংশ ও কাঠ উদ্ধার করেছে। সুন্দরবনে সদ্যুতা দমন ও জেলেদের নিরাপত্তার পাশাপাশি বন্য প্রণী এবং বনজ সম্পদ পাচার প্রতিরোধ এবং এর সাথে জড়িতদের ধরতে কয়রা থানা পুলিশ সর্বদা বনবিভাগের সাথে সমন্বয় করে কাজ করে বলেও জনান কয়রা থানার এই কর্মকর্তা।

বিভিন্ন সময় সুন্দরবনের চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে নেতৃত্বদানকারি কয়রা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ নুর-ই আলম সিদ্দিকী বলেন, সুন্দরবনের বনজসম্পদ রক্ষায় ও পাচাররোধে আমরা তৎপর রয়েছি এবং আমাদের অভিযানও অব্যহত থাকবে। পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।