ইমতিয়াজ উদ্দিন : আজকাল কি বার? কত তারিখ? এসবের কোনো হিসাব থাকছে না। অনেকদিন লিখিনা। লেখাগুলোও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কয়রার মানুষ এখনই ধৈর্যহারা। না থাকতে পারছে ঘরে, না পারছে বের হতে। মানুষ বড় অসহায়। কেউ জানি না শেষ কোথায়? নিজের ভিতরের চাপাকান্না জমিয়ে রাখতে হচ্ছে। এই নীরব কান্নায় কোনো শব্দ নেই। অশ্রু নেই। আছে বুকভাঙা এক নীরব কষ্ট। এমন বিপর্যয়ে কেউ পড়েনি কোনো দিন। এত অসহায় কখনো মনে হয়নি।
এ ভয়াবহতার মাঝেও অন্যায় বন্ধ হয়নি। অনেক মানুষ অপরাধ করে চলেছে। হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো থেকে এখনো নিজেদের মুক্ত করেনি। লুটেরারা এখনো তৎপর। আমরা ভালো হব কবে! মুখ দেখে নিজের মানুষ হিসেবে সহযোগিতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছেন কেউ কেউ। তালিকা থেকে সেইসব নাম আবার প্রশাসনের তদন্তে বাদও যাচ্ছে। এ লজ্জা রাখবো কোথায়।
কয়রা উপজেলা প্রশাষনের হিসেবে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ৪২ হাজারে দাড়িয়েছে। সরকারের ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের এতো এতো উদ্যোগ অথচ এখনও কয়রায় ৪৯৫ জন ভিক্ষুক। কয়রা সদরেই ভিক্ষুকের সংথ্যা ৯৩ জন, ভাবা যায়! উপজেলায় মোট ভবঘুরে রয়েছে ৪৮০, দিনমজুর ৩৭ হাজার ৬শত ৩৯ জন, রিক্সা-ভ্যান চালকের সংখ্যা ২ হাজার ১ শত ৭৪ জন, পরিবহন শ্রমিক ২৫৭ জন, রেষ্টুরেন্ট শ্রমিক ৫১৫ জন, ফেরীওয়ালা ১২০ জন। এছাড়া চায়ের দোকানদার ৮১১ জন। একার্থে বর্তমানে অসহায় হয়েপড়া এই ৪২ হাজার ৪শত ৯৫ জন গরীব মানুষ। সামনের দিনগুলিতে এই সংখ্যা কতোতে দাঁড়ায় কেউ জানে না। তারপরও গ্রাম্য ছ্যাঁচড়ারা রিলিফ চুরিতে তৎপর। কিছুদিন আগে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সরকারি চালের বস্তাও উদ্ধার করেছেন। এই কঠিনতম সময়ে কোনো সুস্থ মানুষ গরিবের ত্রাণ চুরি করতে পারে না। মাঝে মাঝে মনেহয়, সরকারী সকল ত্রাণ তৎপরতা সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই হওয়া উচিত। কারণ তৃনমূল পর্যায়ে মর্যাদাবান জনপ্রতিনিধি খুবই কম।
দায়িত্বশীলরা দয়াকরে চারদিকের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করুন। কয়রার মানুষ ভালো নেই। বাস্তবতা অনুধাবন করুন। নিজের ভোটার বা সমর্থকদের শুধু নয়, যারা দিনে আনে দিনে খায় তাদের অধিকার নিশ্চিতে ভূমিকা রাখুন। কিছু মানুষের ভাবখানা এমন- রিলিফের মাল তো আমারই! এতো প্রতিভা নিয়ে কিভাবে ঘুমান আপনারা, বালিশের কষ্ট হয় না ?
এই কঠিনতম সময়ে কয়রার মানুষ এমনিতেই কষ্টে আছে। নতুন করে আর কষ্ট বাড়াবেন না। করোনায় মৃত্যু মানুষ মেনে নেবে, কিন্তু পেটের ক্ষুধায় মৃত্যু মানুষ সহ্য করবে না। মানুষকে ভালো রাখতে হবে। মানুষ না থাকলে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার কাউকে দরকার নেই।
প্রতিবছর এই সময় কয়রার বিপুল সংখ্যক মানুষ গোপালগঞ্জ-ফরিদপুরে ধান কাটতে যায়। সেখান থেকে ভাগে পাওয়া ধানে বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ের খোরাক মেটে তাঁদের। সেই খোরাকে এবার ভাগ বসিয়েছে করোনা। এবার ধান কাটতে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও পাঁচ হাজার পেরোয়নি। বটবৃক্ষের মতো পরিবার-পরিজনকে ছায়া দেওয়া মানুষগুলো স্বজনদের নিয়ে আজ ভীষণ উদ্বিগ্ন।
ওদিকে করোনার মধ্যে আবার বেড়ীবাঁধ নিয়েও মানুষ চিন্তিত। হরীণখোলা বাঁধটি নির্মানের ৬ মাসও হয়নি, আবার ভাঙছে। নদীর জোয়ার স্বাভাবিকের চাইতে দেড়ফুটর উচু হলেই উপচে নোনা পানি ঢুকবে লোকালয়ে। ২ নং কয়রা বেড়ীবাঁধটি নির্মানে বাঁধের গোড়ার দিকে ৫০ ফুট চওড়া হবার কথা, কিন্তু ২৫ ফুটও হয়নি। বাঁধের উচ্চতা হবে ১১ ফুট, হয়েছে ৮ ফুট। বস্তাগুলি চেহারা দেখাতে রাস্তার উপরে না রেখে দয়াকরে ভাঙনে ফেলুন। কোথায় বলবো? কার কাছে বলবো?
দায়িত্বশিল ব্যক্তিরা দয়াকরে মানুষের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনুন। কাঁদতে ভুলে গেছে কয়রার খেটে খাওয়া মানুষেরা। চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে না। চারদিকের অবস্থায় বোবা আর্তনাদের মতো বাজছে।
তবে এটা বলা যায় যে, সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। এই প্রত্যন্ত কয়রায় করোনাকালিন সময়ে বাজেট এসেছে দেশের তৃতীয় সর্বচ্চ এবং খুলনা বিভাগের মধ্যে সর্বচ্চ বাজেট কয়রার জন্য। তার পরও হাহাকার কেনো? এপর্যন্ত কয়রায় করোনা মোকাবেলায় ইউনিয়ন পরিষদগুলির মাধ্যমে ১৫৯ মেট্রিকটন চাল দেয়া হয়েছে। এছাড়া কয়রার ৭ টি ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ৭ লক্ষ ৬০ হাজার নগদ টাকা ও ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হয়েছে। শুধু তাইনয় কয়রার ১০ টাকা কেজির চাল পায় ১৩ হাজার ৩শত ৬৯টি পরিবার। তারপরও যদি কোনো অসহায় মনুষের কান্না শুনতে হয়, যদি কিছুই পাইনি বলে আক্ষেপ করেন কেউ, তাহলে এই দায় কার? এই জবাব কার কাছ থেকে নেব? নানাভাবে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার মানুষগুলি অনেক কিছু মেনে নিলেও, মনে নেয় না।
জানি না আগামী দিনের দুনিয়ায় কে বাঁচব কে মরব। তবে দিনশেষে একটাই চাওয়া মহান সৃষ্টিকর্তা সবকিছুই দ্রুত স্বাভাবিক করে তুলুক। ততদিন সবাই সবার প্রতি মানবিক হয়ে উঠি।
সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।