বাস্তব কল্পনার চেয়েও অবিশ্বাস্য- বিলেতে অভিবাসী বাঙ্গালি কমিউনিটির সাথে কাজ করতে গিয়ে এই কথাটির সত্যতা আমি প্রতি পদে পদে উপলব্ধি করেছি। নিজের দেখা কঠোর বাস্তবের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকা একজন লেখক হিসেবে লেখার রসদের জন্য আজো কল্পনার জগতে আশ্রয় নিতে হয়নি আমাকে।
কমিউনিটির একজন সদস্য এবং একজন দোভাষী হিসেবে বিলেতের বাঙ্গালি সমাজের, বিশেষ করে নারী এবং শিশুর জীবনের, নানান সমস্যার জীবন্ত কাহিনী বারবার আমাকে ব্যথিত, অভিভূত এবং বিস্মিত করেছে। কিছু ক্ষেত্রে সমস্যার ভয়াবহতা এবং তীব্রতা এতো বেশি যে তা প্রকাশের জন্য নিজের ভাষাকে অপ্রতুল মনে হয়েছে।
‘একজন মায়া অজস্র মধুচন্দ্রিমা’ হচ্ছে আমার প্রথম নাটক ‘মায়া’জ হানিমুনস’ এর উপন্যাস রূপ। এর প্রতিটি ঘটনা বাস্তব, কিছুটা এসেছে আমার নিজের যাপিত জীবন থেকে এবং বাকিটা আমার দেখা বিভিন্ন মানুষের জীবনের গল্প। মায়া একটি কল্পিত চরিত্র যার জীবনকে একটি ইজেলের মত ব্যবহার করে আমার দেখা অনেক নারীর পারিবারিক নির্যাতনের কষ্টের নীল রঙ এঁকে দিয়েছি আমি।
গল্পের নাম ‘একজন মায়া’ হলেও আসলে মায়া একজন নয়। আমাদের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মায়া যাদের জীবনে কপট মধুচন্দ্রিমা আসে ঘুরে ফিরে কিন্তু সুখ কখনোই আসে না। পরবাসী গৃহবধু মায়া যেন মানচিত্রের রেখা পেরিয়ে এক বৈশ্বিক দীর্ঘশ্বাস। আমাদের স্বজন অথবাপ্রতিবেশী মায়াকে আমরা শুধু বাইরে থেকেই চিনি। কিন্তু মায়ার ভেতরের মায়াকে, তার অন্তরের দহনকে কতটা অনুভব করি আমরা? ‘মায়া’জ হানিমুনস’ নাটকটি দেখার পর দর্শকদের মধ্যে থেকে অনেক নারীই আমাকে বলেছেন, ‘এ তো আমার গল্প, আপনি কি করে জানলেন?’ একজন ইতালীয় কবি, যিনি শুধুমাত্র ইংরেজি ডায়ালগগুলো শুনেই গল্পটা উপলব্ধিতে আনতে পেরেছিলেন, নাটক দেখা শেষে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘এই নাটকটির ভিডিও করা হোক এবং প্রতিটি স্কুলে দেখানো হোক’।
গল্পটি পড়তে গিয়ে একসময় মনে হতে পারে, এখানে অনেক বেশি ইস্যু একত্রে পরিবেশন করা হয়েছে। মনে হতে পারে এতো বিভিন্নমুখী সমস্যা, এতো নাটকীয়তা একটা মানুষের জীবনে থাকাটা অবাস্তব। আসলে হিমশৈল’র মত মানুষের জীবনের বেশিরভাগটাই আমাদের অদেখা থেকে যায়। সমস্ত সামাজিকতা, সৌজন্য আর লুকোছাপার আবরণমুক্ত জীবন দেখার সুযোগ সাধারণত আমাদের হয় না। কর্মসূত্রে আমার সেই সুযোগ ঘটেছে এবং অবিশ্বাস্য কিছু বাস্তব ঘটনাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে এই গল্পে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
‘একজন মায়া অজস্র মধুচন্দ্রিমা’ গল্পটি আসলে বৈশ্বিক হলেও বিলেতের বাঙ্গালি জীবনের পটভূমিকায় রচিত। বিলেতে বড় হওয়া একজন অসিলেটি পুরুষের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সিলেটি একটি মেয়ে। গল্পটি এই পরিবারের নানান সমস্যা নিয়েই আবর্তিত। গল্পের চরিত্রগুলোর অভিব্যক্তির প্রতি সৎ থাকতে গিয়ে আমি এই গল্পে সিলেটি, প্রমিত বাংলা, এবং ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করেছি, ঠিক যেভাবে এদেশে বসবাসরত অনেক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কথোপকথন হয়ে থাকে। সিলেটি কথোপকথনে উঠে আসা শব্দগুলোর মধ্যে প্রায় একশত বিশটি শব্দ রয়েছে যা বুঝতে অসিলেটি পাঠকের অসুবিধা হতে পারে। তাদের সুবিধার্থে বই এর শেষদিকে একটি সিলেটি-বাংলা শব্দার্থকোষ সংযুক্ত করা হয়েছে।
লেখক পরিচিতিঃ
প্রয়াত লেঃ কর্ণেল এ আর চৌধুরী ও খায়রুন নাহার চৌধুরীর কনিষ্ঠা কন্যা জেসমিন চৌধুরীর জন্ম ১৯৭১ সালে সিলেটে। স্কুল জীবন সমাপ্ত হতে না হতেই মাত্র আঠারো বছর বয়সে পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় বিলেতে সংসার জীবন শুরু হয় তার। পরবর্তীতে সন্তান পালন ও জীবিকা অর্জনের পাশাপাশি নিজ আগ্রহ ও চেষ্টায় তিনি ঘরে বসে পড়াশুনা চালিয়ে যান এবং একে একে নানান বাধা উত্তরণ করে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রাপ্তবয়স্কদের বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখানোর প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা অর্জন করেন। দীর্ঘদিন সিলেটে শিক্ষকতা করার পর বর্তমানে তিনি ম্যানচেষ্টারে একটি প্রাইভেট কলেজে শিক্ষকতা এবং গ্রেটার ম্যানচেস্টারের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য ফ্রি-ল্যান্স দো-ভাষী হিসেবে কাজ করছেন।
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস থাকলেও প্রকাশিত লেখার জগতে জেসমিন চৌধুরীর পদচারণা শুরু হয়েছে মাত্র কিছুদিন হলো। ২০১৭ সালের একুশের বইমেলায়প্রকাশিত তার প্রথম বই ‘নিষিদ্ধ দিনলিপি’ পাঠকের, বিশেষ করে নিগৃহিত নারীদের কাছে, ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে।
এছাড়াও বিলেতের নাট্যজগতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থেকে বিলেতের বাংলাদেশি কমিউনিটির উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন তিনি। ২০১৬ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘এ সিজন অব বাংলা ড্রামা’ নামক নাট্যোৎসবে মঞ্চায়িত তার প্রথম নাটক ‘মায়া’জ হানিমুনস’ ব্যাপকভাবে দর্শক-নন্দিত হয়েছে। ‘একজন মায়া অজস্র মধুচন্দ্রিমা’ এই নাটকটিরই উপন্যাসরূপ।