প্রতিদিন কেসিসির তেলবাবদ খরচ হচ্ছে ৩০ লিটার
খুলনা : খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) তেলে টুরিস্ট লঞ্চের পর এবার চলছে কাউন্সিলরের ময়লার ভাগার বহন করে পার্ক ভরাটের কাজ চলছে। খুলনার বাইপাস সড়কের পাশে নির্মানাধীনর কারাগারের বিপরীত পাশে প্যানেল মেয়র-২ হাফিজুর রহমান হাফিজের অনন্তনগর নামের এ পার্কটি দীর্ঘ দিন ধরে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। এখানে কাজ করছে মোরসালিন নামের কেসিসির একজন মাস্টাররোল কর্মচারি। তিনি মাটি ভরাটের বিষয়টি দেখভাল করছেন। তিনি নিজেকে কেসিসির মাস্টাররোল কর্মচারি পরিচয় দিয়ে বলেন, তিনি এখানে প্যানেল মেয়র হাফিজ সাহেবের খামার বাড়ী দেখভাল করছেন। তবে এ সময় পার্কের বিপরিত পাশে কেসিসির একজন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা পার্কে রাবিশ ফেলার বিষয়টি নিশ্চিত করছিলেন বলে একটি সূত্র জানায়।
নগরীর ৯বি মজিদ স্মরণীর কেডিএ’র মসজিদ গেটের বিপরীতে নির্মানাধীন আই হাসপাতালের ভাগার কেসিসির গার্বেজ বহনকারী গাড়ীতে করে দীর্ঘ দিন ধরে প্যানেল মেয়র-২ হাফিজুর রহমান হাফিজের প্রস্তাবিত পার্ক ভরাট করে আসছে। অথচ এ ভাগার যাওয়ার কথা রাজবাধে। কিন্তু রাজবাধে না গিয়ে কেসিসির কতিপয় কর্মকর্তাদের যোগসাজসে তা বহন করে তার পার্কের ফেলা হচ্ছে। লোডার দ্বারা ভরাট করে ওই গাড়ী পার্কে রাবিস (ডাস্ট) নিয়ে চলে যায়। লোডারের জন্য প্রতি ট্রিপে ব্যয় হচ্ছে ৩/৪ লিটার আর গার্বেজ ট্রাক বাবদ প্রতি ট্রিপে খরচ হচ্ছে ৫/৬ লিটার তেল। প্রতি লিটার তেলের দাম ৬৫ টাাকা। এ হিসেবে প্রতিদিন শুধু তেল বাবদ কেসিসি গচ্ছা যায় প্রায় দু’ হাজার টাকা। এ হিসেবে মাসে প্যানেল মেয়রের পার্কে রাবিস ফেলার জন্য তেল বাবদ খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। আর চালকদের পিছনে রয়েছে আরো খরচ। গত ২/৩ বছর ধরে এ পার্কটি ভরাটের কাজ চলছে। কেসিসির বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভবন বা সড়ক সংস্কারের রাবিস ও পেরি মাটি সড়কের পাশে রাখা হয়। পরে তা প্যানেল মেয়র হাফিজুর রহমান প্রভাব খাটিয়ে এসব রাবিস কেসিসির গার্বেজ ট্রাক দিয়ে বহন করে তার পার্কটি ভরাট কাজ অব্যাহত রেখেছেন। অফিসিয়াল কোন অনুমোদন ছাড়াই এ কাজ করছেন এ প্যানেল মেয়র। শুধু তিনি একা নন, কেসিসির গার্বেজ বহনকারী ট্রাক দিয়ে অধিকাংশ কাউন্সিলর ও কর্মকর্তারা তাদের ব্যক্তিগত মালামাল পরিবহন করে থাকেন। এটা দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসায় অনেকটা অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, কোন কাউন্সিলর তার নিজস্ব কাজে গাড়ী ব্যবহার করতে চাইলে ইচ্ছা থাকা সত্বেও তারা না বলতে পারেন না।
এসব রাবিস ফেলার নিয়ম হচ্ছে রাজবাধ এলাকায়। যেখানে কেসিসির নির্ধারিত ময়লা ডাম্পিং পয়েন্ট রয়েছে। রাবিসের অভাবে ডাম্পিং পয়েন্টে ময়লা ভর্তি ট্রাক প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। কেসিসির আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কথা হয় গার্বেজ ট্রাক চালক দেলোয়ারের সাথে। যার গাড়ীর নং- । তিনি অভিযোগের সত্যতা স্বীকার কের বলেন, ‘লোডার চালক বাবলুর নির্দেশে তিনি এক ট্রাক রাবিশ শিববাড়ী মোড় থেকে নিয়ে হাফিজ সাহেবের পার্কে ফেলা হয়েছে। এক ট্রিপ নিতে তেল খরচ হয় প্রায় ৫ লিটার। তবে রাজবাধে নিতে খরচ বেশীর কথা চিন্তা করে পার্কে ফেলা হয়েছে। এছাড়া ওয়াসার মাটি আসার পর আর কেউ রাবিশ নিতে চায় না। পেরিমাটি কেউ আর কিনতে চায় না। এ জন্য এসব মাটি ও রাবিশ যে যেখানে সুবিধা পায় সেখানেই ফেলে। লোডার চালক বাবলু অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি গতকাল বিকেলে কেডিএ মসজিদ মোড় থেকে ৯ ট্রাক রাবিশ লোড দিয়েছেন। ওই রাবিশ রাজবাধে যাওয়ার কথা। তবে এক ট্রাক মাল যদি কাউন্সিলর চান তাহলে তাকে দেয়াই যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। গত ২৫ জানুয়ারী বিকেলে একই কায়দায় একই স্থান থেকে রাবিশ যায় ওই প্যানেল মেয়রের পার্কে। ওখান থেকে তিন ট্রাক রাবিশ লোড দেয়া হয়েছে বলে জানান লোডার রেজাউল। তবে চালকরা ওই মাল কোথায় ফেলেছে তা তিনি বলতে পারেন না। তিনি জানান, চালকরা সেলিম সাহেব ও প্যানেল মেয়রের সচিব আঃ হকের নির্দেশে ওই পার্কে রাবিশ ফেলতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন। গার্বেজ ট্রাক চালক ইসমাইল গাজী বলেন, লোডার রেজাউলের নির্দেশে তিনি এক ট্রাক রাবিশ পার্কে ফেলেছেন। বাকী দু’ ট্রাক রাবিশ কে পার্কে ফেলেছে তা তিনি বলতে পারেননি। তবে গতকাল পার্কে গিয়ে দেখা যায়, কেসিসির গাড়ীতে বহন করে রাবিশ দিয়েই ভরাট কাজ চলছে পার্কটি। এ প্রতিনিধির সামনেই গার্বেজ ট্রাক চালক দেলোয়ার রাবিশ পার্কে আন লোড করে।
এভাবেই বছরের পর বছর ধরে প্যানেল মেয়র হাফিজের পার্ক ভরাট করা হচ্ছে কেসিসির গার্বেজ ট্রাক দিয়ে রাবিশ ও পেরিমাটি নিয়ে। কোন অফিসিয়াল অনুমতি লাগছে না এসব লোডার ও চালকদের। কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা আর কতিপয় সুবিধাবাদী কাউন্সিলরের নির্দেশনায় কোন নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই কেসিসি তেল আর গাড়ী ব্যক্তি কাজে ব্যবহার করে আসছে। বিষয়টি যাদের দেখার কথা তারা দেখছে ঠিকই। কিন্তু রহস্যজনক কারণে রয়েছে নিরব বলে সূত্রটি জানায়।
কেসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আব্দুল আজিজ জানান, ড্রেনের মাটি ফেলার জায়গা বা লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তাই যে চাচ্ছে তার ঠিকানাতেই মাটি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। মাটিতো সরানো জরুরি।
কেসিসির প্যানেল মেয়র-২ শেখ হাফিজুর রহমান হাফিজ বলেন, অনন্তনগরে মাটি ভরাটের জন্য পে অর্ডারের মাধ্যমে কেসিসির প্রত্যাশিত অর্থ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী তার প্রত্যাশিত মাটি এখনও দেওয়া হয়নি। খালিশপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে ড্রেনের কিছু পেড়ি মাটি এখানে ফেলা হয়েছে। যা নিয়ে রাজবাঁধে গাড়ি যেতে কেসিসির খরচ আরও বেশি হত।
এ ব্যাপারে কথা হয় কেসিসির মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে অফিসিয়াল অনুমোদন ছাড়া কেসিসির গাড়ী ও তেল ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। তিনি বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন বলে জানান।
উল্লেখ্য, নগরীর ৪নং ঘাটস্থ বিআইডাব্লিউটিএ টার্মিনাল মার্কেটে অবস্থিত শেখ আব্দুল কুদ্দুসের মালিকানাধীন ‘নিউ রেইনবো ট্যুরস’ নামক একটি ভ্রমন সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানের গাইড মো. হাসানুজ্জামান হেলাল ১৪ ডিসেম্বর’১৭ ভ্যান নিয়ে তেল নিতে নগরীর পাওয়ার হাউজ মোড়স্থ মেসার্স সিটি পেট্রোলিয়াম নামক তেল পাম্পে যান । তিনি যথারীতি কেসিসির যান্ত্রিক ও কঞ্জারভেন্সি শাখা থেকে বরাদ্দকৃত ডিও (বরাদ্দ পত্র) পাম্পে জমা দিয়ে দু’টি বড় ড্রামে ৩শ’ লিটার তেল ভর্তি করে নিয়ে রওনা হচ্ছিলেন। কিন্তু এ সময়ই তাদের আটক করা হয়। তবে পরে আটককৃতদের ছেড়ে দেয়া হয়। আটককৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে কেসিসির ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল হালিমের নিকট স্বীকার করে, ২৮নং ওয়ার্ডের কনজারভেন্সী সুপারভাইজার আব্দুস সালাম (বর্তমানে পাম্প থেকে তেল সরবরাহের কাজে নিয়োজিত) এবং কঞ্জারভেন্সি শাখার সহকারী ওমর ফারুক তাদের কাছে তেলের ডিও স্লিপ বিক্রি করেছে। পরে এ ঘটনায় তদন্ত টিম গঠন করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও তদন্ত রিপোর্ট দাখিল হয়নি।