কামরুল হোসেন মনি : সকাল সাড়ে ৯টা। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে মহিলা টিকিট কাউন্টারে মহিলাদের দীর্ঘ লাইন। টিকিট কেটেই নির্দিষ্ট ডাক্তারের চেম্বারের সামনে অবস্থান করছে রোগীরা। যারা চিকিৎসা নিতে এসেছে তারা এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে চিকিৎসকের খোঁজ করছে। কেউ বা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ বা বেশি অসুস্থ থাকায় মেঝেতে শুয়ে আছেন। কখন চিকিৎসক আসবেন কেউ জানেন না। হাসপাতালে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরা না থাকায় কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে কতিপয় চিকিৎসক সময়মত চেম্বারে উপস্থিত হননা।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে (মেডিসিন) ও চর্ম ও যৌন ব্যাধি বিভাগে এসব চিত্র গতকাল বুধবার সকালের। এ ছাড়া সরেজমিনে গিয়ে হাসপাতাল ঘুরে ওষুধ প্রতিনিধি ও দালালদের দৌরাত্ম্যও চোখে পড়ে।
সরকারিভাবে নিয়ম রয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত অবস্থান করবেন। কিন্তু বাস্তবে কতিপয় চিকিৎসক সময়মত সরকারি হাসপাতালে চেম্বারে আসেন না।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে ২য় তলার ২১২নং রুমে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মহিলা রোগীদের দীর্ঘ লাইন। তাদের কেউ রোগী, কেউ চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজন। অনেক বয়স্ক ও অসুস্থ রোগী চিকিৎসকের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ২১২নং রুম (মেডিসিন) মহিলা রোগী দেখেন মেডিকেল অফিসার ডাঃ সুমন রায়। ওই ডাক্তারের চেম্বারে মধ্যে বসে থাকা এক য্বুক এ প্রতিবেদককে জানান, ডাক্তার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে আাসতে পারেন। এরই মধ্যে দেখা গেলো ওষুধ প্রতিনিধিরা একে একে ওই চেম্বারে প্রবেশ করছেন। রোগীরা বাইরে চিকিৎসকের জন্য অবস্থান করছেন।
জানা গেছে, ডাক্তার সুমন রায় আসেন ইচ্ছেমত। বেশির ভাগ সময়ই তিনি ১১টায় চেম্বারে আসেন। ডাক্তার সুমন রায়ের বিরুদ্ধে রোগীর স্বজনকে মারধর করার অভিযোগও রয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে খুমেক হাসপাতালে মায়ের চিকিৎসা করাতে এসে ছেলে সাইফুল ইসলামকে মারধর করেন ডাঃ সুমন রায়। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী ওই চিকিৎসকরে বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগও দেন। সিরিয়াল ছাড়া পেছনের দরজা থেকে অনেক লোকজন ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করার বিষয়টি অবহিত করায় তাকে মারধর করা হয়।
চিকিৎসা নিতে আসা কোহিনুর বেগম জানান, সকালে বাগেরহাট থেকে এ হাসপাতালে উদ্দেশে রওনা দিছি। এখানে সকাল সাড়ে ৮টায় পৌঁছেছি। এখন বাজে সাড়ে ১০টার কাছাকাছি, চিকিৎসকের খবর নেই।
খুমেক হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ৪০৩ নম্বরে রুমে রোগী দেখেন চর্ম ও যৌন ব্যাধি বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ মহাদেব কুমার অধিকারী। তার চেম্বারের সামনে মহিলা ও পুরুষ রোগীর দীর্ঘ লাইন। রোগীরা অতিষ্ঠ হয়ে চেঁচামেমিচি শুরু করেন। এ সময় এক যুবক রোগীদের টিকিট নিয়ে অন্য চর্ম-যৌন চিকিৎসক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মিসকাতুস সালেহীর চেম্বারে নিয়ে যান। এ সময় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা প্রতিবাদ করলে ওই যুবক বলেন, ডাঃ মহাদেব কুমার অধিকারী আসতে আরও দেরি হবে। খুমেক হাসপাতালে বহির্বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সময়মত চেম্বারে না আসার অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিনের।
এদিকে, হাসপাতালের দ্বিতীয় তলা ও চতুর্থ তলায় ওষুধ প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য দেখা গেছে। প্রতিটি চিকিৎসকের চেম্বারে দলে দলে ওষুধ প্রতিনিধিদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তারা রোগীকে আটকিয়ে প্রেসক্রিপশনে ছবি নিচ্ছেন, কেউ বা চিকিৎসকের চেম্বারের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছেন আবার অনেকে দল বেঁধে গেটের সামনে রোগীদেরকে আটকাচ্ছেন। রোগীরা বিরুক্ত বোধ করলেও কিছু বলতেও পারেন না। খুমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড ও মেডিসিন বিভাগে ওষুধ প্রতিনিধিদের আনাগোনা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। চিকিৎসকদের রুমে রোগীদের ছাড়পত্রে ওষুধ প্রতিনিধিদের প্রেসক্রাইব করতেও দেখা গেছে। ওষুধ প্রতিনিধিরা তাদের কোম্পানির ওষুধ রোগীর ছাড়পত্রে উল্লেখ করছেন।
বহিঃবিভাগের মহিলা কাউন্টারে সামনে মহিলা রোগীদের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে। হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মহিলারা দালাররা রোগীদের ভাগিয়ে নেওয়ার জন্য নানা প্রস্তাব দিচ্ছেন। অল্প টাকায় সরাসরি ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিতে দেখা যায়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এটি এম মঞ্জুর মোর্শেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সকল চিকিৎসকের সময়মত হাজিরা নিশ্চিতের লক্ষ্যে মেশিন চলে আসছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এই মেশিনটি স্থাপন করা হবে। এছাড়া হাসপাতালে রোগীদের সেবার মান নিশ্চিতের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ৩০ জনের মত লোক নেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার প্রশিক্ষণ দেওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দালালমুক্ত ও ওষুধ প্রতিনিধিদের অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। হাসপাতালের সেবার মান আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া তা সবই করা হবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে ঢাকাসহ আটটি জেলার ১১টি সরকারি হাসপাতাল একযোগে পরিদর্শন করে ৪০ শতাংশ চিকিৎসককে কাজে পাননি দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।
অভিযানে দেখা যায়, ঢাকার বাইরে সাতটি হাসপাতালে অনুপস্থিত চিকিৎসকের হার ৬১.৮ শতাংশ। অর্থাৎ বেশিরভাগ চিকিৎসক কাজেই আসেন না। কিন্তু মাস শেষে বেতন তুলে নেন। দুদক জানতে পেরেছে, উপজেলা হাসপাতালগুলোতে শীর্ষ কর্মকর্তারা মাসের বেশিরভাগ সময় অনুপস্থিত থাকেন। এ সুযোগে কনসালটেন্ট ও মেডিকেল অফিসাররাও কর্মস্থলে ঠিকমত হাজির থাকেন না। অনেকে সপ্তাহে দুই একদিন হাজিরা খাতায় সই করে পুরো মাস অনুপস্থিত থাকেন এবং পুরো মাসের বেতন উত্তোলন করেন। চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির কারণে হয়রানির শিকার রোগীদের পক্ষ থেকে দুদক হটলাইন ১০৬ নম্বরে অভিযোগ আসার পর এই অভিযান চালানো হয়। ##