মানস চৌধুরী, চট্টগ্রাম : সারা বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রামকে করোনা রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও উপজেলা গুলোর মধ্যে পটিয়া এখন করোনা রেডজোন এ পরিণত হয়েছে।
পটিয়ায় প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। একই সাথে দীর্ঘ হচ্ছে মৃতের সংখ্যাও। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। পটিয়ায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১২ এপ্রিল। ওইদিন থেকে ৪ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামের উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫৯ জনে ঠেকেছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত পটিয়ায় করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে ৪ জন। করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে আরো অনেকে। যাদের নমুনাও নেওয়া সম্ভব হয়নি।
করোনা চিকিৎসায় সংশ্লিষ্টরা জানান, এপ্রিল পর্যন্ত কড়াকড়ি অবস্থা ছিল। মানুষ ঘর থেকে কম বের হয়েছে। তাই শনাক্তের সংখ্যা ও হার অনেক কম ছিল। মে মাসের শেষে দিকে সব ঢিলেঢালাভাবে চলতে থাকে। ঈদের পর খোলা হয় সরকারি-বেসরকারি অফিস, গণপরিবহন, গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটসমূহ। এতে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের (গোষ্ঠী সংক্রমণ) দ্রুত বিস্তার ঘটছে। করোনা বিস্তার রোধের জন্য বিশেষজ্ঞরা যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেও পরামর্শ দেন তাঁরা। নইলে বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হবে।
পটিয়ায় সচেতন জনসাধারণ মনে করেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিপজ্জনক এলাকা এখন পটিয়া । প্রতি দিনেই কারো না কারো শরীরে ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রামের উজেলাগুলোর মধ্যে এক নম্বরে উঠে এসেছে পটিয়া । সাধারণ ছুটির সময়ে সরকারি ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা না মেনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশের লোকজন পটিয়া যাতায়াত করেছে। পোশাক কারখানা চালু হওয়ার কারণে কর্মীরা পটিয়াতে ফিরে আসেন। এরপর গত ৩০ মে শুরু হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিসের কার্যক্রম। একদিন পর পহেলা জুন থেকে শুরু হয় গণপরিবহন চলাচল। একই সাথে খুলেছে নগরীর কিছু কিছু মার্কেটও। এর মধ্যে অনেকের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাও বাড়ছে। ফলে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
উপজেলার হাইদগাঁও ইউনিয়নের ছয় বছর বয়সী এক প্রতিবন্ধী (বোবা) শিশুর শরীরে করোনার সংক্রমন পজিটিভ আসে গত ১২ এপ্রিল রাতে। এ শিশুর পথ অনুসরণ করেই পটিয়ায় করোনার হানা শুরু হয়। এই একজনই ছিলেন এই উপজেলার করোনা আক্রান্ত করোনা আক্রান্ত প্রথম দেশের কোন শিশু রোগী। দুঃখ জনক আক্রান্ত হওয়ার সেদিন রাতেই জেনারেল হাসপাতালেই নেওয়ার পরেই মারা যান শিশুটি। একজন দিয়ে শুরু হওয়া এই আক্রান্ত সংখ্যা দেড় মাসের ব্যবধানে গিয়ে ঠেকেছে ১৫৮ তে দাঁড়িয়ে এখন ছোঁয়ার অপেক্ষা করছে দুই শতকের ঘর।
গত ১২ এপ্রিলের পর হতে দু-এক দিন পরপর এক-দুই জন করেই বাড়ছিল আক্রান্তের সংখ্যা। কিন্তু ২ জুন একদিনেই আক্রান্ত হন ৪৯ জন। পরদিন আক্রান্ত সংখ্যার পারদ এক লাফেই উঠে যায় আশংকাজনক অবস্থানে। এক দিনে চট্টগ্রামের কোনো উপজেলায় করোনায় এত আক্রান্তের সংখ্যা এটিই সর্বোচ্চ। সর্বশেষ গতকাল ৪ জুন একদিনে আক্রান্ত হন আরো ১১ জন।
স্থানীয় সচেতন জনসাধারণ আরো জানান, চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোর মধ্যে পটিয়া এখন করোনার ডেঞ্জার জোনে পরিণত হয়ে উঠেছে। একদিনের ব্যবধানে সর্বশেষ চারগুণ পর্যন্ত বেশি রোগী সনাক্ত হয়েছে। এছাড়া উপসর্গসহ ও উপসর্গ বিহীনঅনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঈদ কেনাকাটা ও দেশের বিভিন্ন স্হান হতে ঈদের ছুটিতে আসা লোকজন আর অসচেতনতার কারণে পটিয়া করোনার হটস্পট হয়ে উঠেছে। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে পটিয়া মানুষের সমাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হয়েছে উপজেলা প্রশাসনকে।
এখনই যদি পটিয়ায় কোন ধরনের কার্যকরি প্রদক্ষেপ গ্রহন না করে উপজেলা প্রশাসন তাহলেই অচিরেই পটিয়া হয়ে উঠবে মৃত্যুুপূরিতে।
পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, কোভিড-১৯ বাংলাদেশে সংক্রমণের শুরু থেকে উপজেলা প্রশাসনের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করোনা/ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ২ টি কেবিনে ৪ টি বেডকে আইসোলেশন বেড হিসেবে প্রস্তুত করা হয় এবং টেলিমেডিসিন সেবা শুরু করা হয়। বর্তমানে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে ১৩৯ জন করোনা/ কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে, যাদের মধ্যে ৪৭ জন এরই মধ্যে সুস্থ হয়েছেন, ভর্তি আছেন ৪ জন আর অন্যদের উপসর্গ উন্নতির দিকে হওয়ায় উনারা হোম আইসোলেশনে থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিবিড় তত্বাবধানে চিকিৎসা চলছে। এরই মধ্যে আমরা একজন পজিটিভ রোগীকে গত ২৭ মে -৩০ মে পর্যন্ত আমাদের আইসোলেশন ইউনিটে রেখে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। পরবর্তীতে তার অবস্থার উন্নতি না হলে তাকে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। বর্তমানে তিনি সুস্থতার পথে। এছাড়া আমাদের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ১ জন করোনা পজিটিভ পুলিশ সদস্য ও ১ জন করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি আছেন। এছাড়া আমাদের তত্বাবধানে যাদের অবস্থার অবনতি হয় তাদের চট্টগ্রাম স্পেশাল ব্রাঞ্চ এর সহায়তায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে থাকি।এই পর্যন্ত আমরা ৪৭২ টি নমুনা সংগ্রহ করেছি। আমরা বর্তমানে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের নির্দেশনায় প্রতিদিন ৩০ টি বেশি নমুনা সংগ্রহ করতে পারছি না। আমরা নমুনা সংগ্রহ করে ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি তে পাঠায়। উনারা আমাদের পরীক্ষার পর রিপোর্ট জানিয়ে থাকেন। চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার স্যাম্পল যেহেতু উনারা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে থাকেন তাই তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী রিপোর্ট দিতে সময় নিয়ে থাকেন। তাই আমরা বেশি স্যাম্পল পাঠালে রিপোর্ট পেতে সময় লেগে যায়। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমাদের স্যাম্পল সংগ্রহ করতে হয়। নমুনা সংগ্রহে রোগীকে কোন খরচ বহন করতে হয় না। বর্হিঃবিভাগে ১১০ নং রুমে( ফ্লু- কর্ণার) জ্বর, সর্দি- কাশি ও করোনা উপসর্গ নিয়ে আসলে আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা ও পরীক্ষার উপদেশ দিয়ে থাকি। পটিয়াবাসী আমাদের পাশে থাকলে আমরা আশা করি খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।
এ ব্যাপারে পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা জাহান উপমা বলেন, শুরু থেকে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে আমরা বিরামবিহীনভাবে কাজ করে গেছি। মানুষ সচেতনতা, সামাজিক দূরত্ব মানার ক্ষেত্রে প্রশাসনের সাথে রীতিমতো লুকোচুরি খেলেছেন। অনেকে নানা অযুহাতে নিয়ম মানেননি। দোকানের সামনে দরজা বন্ধ রেখে পেছনের দরজা দিয়ে বেচাকেনা করেছেন। আমরা অভিযান পরিচালনা করে আসার পরে দেখেছি তারা আবারো দোকান খুলেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘নিয়ম না মানা ও অসচেতনতার কারণে আজ পটিয়া করোনার হটস্পটে পরিণত। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে প্রতিটি সচেতনতামূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়য়ে বেগ পেতে হচ্ছে উপজেলা প্রশাসনকে।
তিনি জানান, গতকাল শান্তির হাট এলাকায় গেলাম। কেও বলবে না এখানে করোনা বলে কিছু আছে/ পটিয়া রেড জোন হিসেবে পরিগনিত হচ্ছে। এখানে অসংখ্য মানুষ। কেও ফুচকা খাচ্ছেন রাস্তার পাশে আয়েশ করে, কেও মাস্ক পকেট এ রেখে বীরের মতো হেঁটে যাচ্ছেন। তাদেরকে দেখে মাস্ক পরা লোকজন লজ্জা পাচ্ছে বৈকি। করোনা ভাইরাসের অনুভূতি থাকলে নিশ্চিত লজ্জা পেত।
দোকাম খোলা কেন জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিচ্ছেন ‘এইতো বন্ধ করব, মালপত্র আসলো, তাই খুললাম।’। জরিমানা করতে গেলে বলছেন, ‘ জরিমানার টাকা কোত্থেকে দিব। এবারের মতো মাফ করে দিন। আর হবে না। জরিমানা দেয়ার টাকা নেই সাথে।’
অনেকে আবার এক ধাপ উপরে। সেদিন একজনকে দাঁড় করানো হলো, মাস্ক না পরাতে। তিনি মাস্ক ছাড়াই মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, জরিমানা করতে গিয়ে দেখা গেল, তার সাথে ৫০ টাকা ছাড়া আর কোন টাকা নেই। বেশির ভাগ মাস্ক বিহীন জনতাই উঠতি বয়সী ছেলে, যাদের পকেট এ এক টাকাও থাকে না। বাস্তবতার নিরিখে তাদেরকে জরিমানা করার পর আদায় করতে গেলে কয়েক ঘন্টা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে যায় তাদের অভিভাবক এর মাধ্যমে তা স্পটে আদায় করতে গেলে। গত ২ জুন রিপোর্টে যে ৪৯ জন নতুন রোগীর করোনা পজিটিভ আসছে তাদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যাদের কোন উপসর্গ নেই বলে জানা গেল। তাদের ঘর লকডাউন করার পরও তারা কারো কথা শুনছেন না, তারা ঘর থেকে বের হবেনই হবেন। কারণ, তাদের বক্তব্য হলো, ‘আমরা তো সুস্থ, কে বলেছে আমাদের করোনা আছে?