চট্টগ্রাম ব্যুরো: ৬ কিলো সড়ক নির্মাণ করতেই ছোট-বড় ১৮টি পাহাড় কেটে সাবাড় করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসারে পাহাড় কাটার কথা ছিল ২৬ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। কেটেছে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে।
নগরের অন্যান্য সড়কের চাপ কমানোর কথা বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিলেও মানা হয়নি পুরোপুরিভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা।
বিশ্বের অনেক দেশই পাহাড়কে অক্ষত রেখেই সড়ক নির্মাণ করলেও ঝুঁকিপূর্ণভাবে ৯০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে চট্টগ্রাম। সড়কটি নির্মাণের পর আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া না হলেও যান চলাচল করছে প্রতিনিয়ত। এরইমধ্যে বৃষ্টির সাথে সাথে কয়েকদফা বেশ কয়েক জায়গায় খাড়া পাহাড় ধ্বসে পড়েছে সড়কের ওপর। ফলে সাময়িক সমাধান হিসেবে সিডিএ ওই সব স্থানে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। তবে ব্যস্ত এ সড়কে যে কোন সময়ে ঘটতে পারে পাহাড় ধ্বসের ঘটনা।
বায়েজিদ-ফৌজদারহাট বাইপাস সড়কটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিলিত হয়েছে। শহরের অন্যান্য সড়কের চাপ কমানোর কথা বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেয় সিডিএ।
সিডিএ ছয় কিলোমিটার বা ৪ মাইল সড়ক নির্মাণ করতেই ছোট-বড় ১৮ টি পাহাড় কেটেছে। ২৬ ডিগ্রি করে পাহাড় কাটার অনুমতি থাকলেও কাটা হয়েছে ৯০ ডিগ্রি পাহাড়। যেটা পুরোপুরিভাবে কাটিং ম্যানেজমেন্ট প্লানেরই লঙ্ঘন। যার জন্য ১০ কোটি টাকার জরিমানাও ঘানি টানতে হয়েছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছয় কিলোমিটার রাস্তার দুপাশেই পাহাড় কাটার চিহ্ন। কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়াই পাহাড়গুলো কাটা হয়েছে। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা। ইতিমধ্যে এমন দুর্ঘটনা অনেক ঘটেছে এ ছয় কিলোমিটার রাস্তার দুপাশের এলাকাতে। বিশেষ করে বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড় কাটার ফলেই সম্প্রতি পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটছে। পাহাড় ধ্বসে ছিন্নমূল মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশরও।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ছয় কিলোমিটার এ বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের এক পাশে অবস্থিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং বহিঃসীমা দিয়ে লুপরোড নির্মাণসহ ট্রাংক রোড হতে বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) গত জানুয়ারিতে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। প্রকল্পটি শুরুর আগে সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে এ সড়ক নির্মাণে আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড়, টিলা ও মাটি কাটার প্রয়োজন হতে পারে বলে নির্ধারণ করা হয়। আর এ নির্দেশনা মানার শর্তে সিডিএকে জাতীয় স্বার্থে সড়কটি নির্মাণের জন্য ছাড়পত্র দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে জরিমানার আগে সড়কটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১০ লাখ ২৮ হাজার ৭০০ ঘনফুট মাটিসহ ১৮টি পাহাড় কাটা হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে। অর্থাৎ অনুমোদন-বহির্ভূতভাবে প্রায় আট লাখ ঘনফুট অতিরিক্ত পাহাড় কাটা হয়েছে। সেজন্য সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এসব বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়েই এ বাইপাস সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের সব রকম নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এর সাথে পাহাড় ধ্বসের কোনো সম্পর্ক নেই। পাহাড় দীর্ঘদিন স্থির থাকে না। এটি প্রাকৃতিক ভাবে সময় সময় ধ্বসে পড়ে। তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তর গত জানুয়ারিতে সিডিএকে জরিমানা কেন করলো এমন প্রশ্ন করতেই তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই সময় গৃহীত প্রকল্পটি ১৯৯৯ সালে একনেকে পাশ হয়। এরপর ২০০৪ সালে ৫৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ফৌজদার হাট থেকে কাজ শুরু হয়। নির্মিত হয় ব্রিজসহ নানা স্থাপনা। পরবর্তীতে রাস্তাটির কাজ নিয়ে এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটির সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই রাস্তার জন্য যখন ভূমি হুকুম দখল করা হয় তখন এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটিকেও ১০৪ একর ভূমি দেয়া হয়েছিল। রাস্তা নির্মাণের সময় দেখা যায় যে প্রায় ৪ হাজার ফুট বা ১.২২ কিলোমিটার রাস্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪ একর এলাকার মধ্যে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তাদের ভেতর দিয়ে রাস্তা যাওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি তোলে।
এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটি সিডিএ কর্তৃক নির্মিত রাস্তার ওই অংশটি তাদের নিকট হস্তান্তর করে ক্যাম্পাসের বাইরের অংশ দিয়ে নতুন রাস্তা তৈরির দাবি জানায়। ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে যাওয়া রাস্তা তারা অভ্যন্তরীণ রোড হিসেবে ব্যবহার করবে এমন শর্তও জুড়ে দেয়। সিডিএ আপত্তি করলে বেঁকে বসে এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটি। এক পর্যায়ে নারী শিক্ষার অনন্য এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। এতে রাস্তাটির বিভিন্ন অংশ নির্মিত হলেও কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরিত্যক্ত হয়ে যায় পুরো প্রকল্প। পরবর্তীতে নানা দেন-দরবারের পর রাস্তাটি নির্মাণের গুরুত্ব সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তুলে ধরা হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এশিয়ান উইম্যান ইউনির্ভাসিটির ভেতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি তাদের ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর পাশ ঘেঁষে নতুন রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। নতুন করে গ্রহণ করা হয় প্রকল্প। ব্যয় নির্ধারণ হয় প্রায় ২১০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে আরো কিছু খরচ কমিয়ে প্রকল্প ব্যয় ১৭২ কোটি ৪৯ লাখ ৩২ হাজার টাকায় নির্ধারণ করা হয়। আগের কাজগুলো পরিত্যক্ত হয়। প্রকল্প ব্যয় উন্নীত হয় ৩২০ কোটি টাকায়। বর্তমানে সড়কটি জনসাধারণের জন্য খুলে দিয়েছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষ।