ইমতিয়াজ উদ্দিনঃ সুপার সাইক্লোন আম্ফানের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা। বিধ্বস্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক ঘরবাড়ি। বিশেষ করে নদীর বাঁধ ভেঙ্গে নোনাপানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে কয়রা উপজেলার ৮০ ভাগ এলাকা। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নিলে তো নিজেদেরকেই প্লাবনের হাত থেকে এলাকাকে রক্ষা করতে হবে। তাই ঝড়ের পরদিন সকাল থেকেই এলাকার মানুষ সেচ্ছাশ্রমেই শুরু করেছে বাঁধ সংষ্কারের কাজ। এমনকি ঈদের দিনেও ভোর থেকে সাত হাজারের বেশি মানুষ মিলে স্বেচ্ছায় বাঁধ রক্ষার কাজ করেছেন। তবে কয়রার মানুষের এই দুর্ভোগ দুর্দশা ছাপিয়ে আলোচনার ঝড় শুরু হয়েছে ঈদের নামাজ আদায় নিয়ে।
ঈদের দিন কয়রা উপজেলা সদরের দুই নম্বর কয়রা গ্রামের একটি অংশের মানুষ বিলের মধ্যে জোয়ারের পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেন। ওই ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃস্টি করে। তবে একটি পক্ষ এটিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। আর এতেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে কয়রাবাসীর মধ্যে।
পানিতে দাঁড়িয়ে ওই ঈদের জামাতের ইমামতি করেন খুলনা দক্ষিণ জেলা জামায়াতের সাবেক আমির ও কয়রা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আ খ ম তমিজ উদ্দিন। আর এটাকেই ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন সরকারি দলের একাংশের নেতারা। তবে সাধারণ মানুষ বলছেন, তমিজ উদ্দিন এলাকার প্রবীন একজন আলেম। এলাকার কেউ মারা গেলে নামাজের জানাযা তিনিই পড়ান। তাঁর পেছনে এ-র আগে একাধিক বার নামাজ পড়তে দেখা গেছে সমালোচনাকারী নেতাদের। এলাকাবাসীর দাবি, তমিজ উদ্দিন জামাত নেতা হিসেবে নয়, একজন প্রবীণ আলেম হিসেবে তার পেছনে সবাই সেদিন ঈদের নামাজ পড়িয়েছিলেন। আর জামাতে অংশ নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। অন্য সময় তাঁকে নিয়ে কথা না উঠলেও এখন কেন উঠছে তা বুঝতে পারছেন না কয়রাবাসী।
তাঁরা দাবি করেন, কয়রার মানুষ আম্পানের পর কয়রার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানে। এ কারণে ওই ঘটনাকে তাঁরা স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন। আর যারা ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা কেউ কয়রার মানুষ নয়, কয়রার মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার ঘটনাও তাঁদের অজানা।
পানিতে নামাজ আদায়কে যে দুই জনের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে তাঁদের একজন হলেন উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম। উপজেলা যুবলীগের সভাপতি তিনি। বিদ্রোহী হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম মহসিন রেজার বিপক্ষে উপজেলা নির্বাচন করে বিজয়ী হন। এ কারণে মহসিন রেজা ও তাঁর কয়েকজন অনুসারি জামাত-বিএনপির তকমা দিয়ে শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তাঁরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মহসিন রেজা বলেন, বাঁধ মেরামত বা সংস্কার নিয়ে কয়রাবাসীর কারোর মধ্যেই কোনো দ্বিধা নেই। তবে সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে ওইদিন পরিকল্পিতভাবেই সরকারকে বিব্রত করার জন্য পানিতে নামাজ আদায় করা হয়েছে। জামায়াত নেতা তমিজ উদ্দিন অন্যদিন বাঁধ নির্মাণের কাজে না গেলেও ওইদিন কেন গেলেন বা কেন পানির মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া জামাতে তিনি ইমামতি করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
ওই দিন ওই এলাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া মোট তিনটি ঈদের জামাতের দুটি অনুষ্ঠিত হয় বাঁধের ওপর। যার একটির ইমামতি করেন সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগেও দুই একদিন তমিজ উদ্দিনকে স্বেচ্ছায় বাঁধ নির্মানের কাজ করতে দেখা গেছে। সেদিন তাঁর পেছনে নামাজ পড়েছিলেন আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ। নামাজের পর বাঁধের কাজ করার কথা থাকলেও সকাল থেকে মানুষ জড়ো হওয়ায় আগেই বাঁধের কাজ শুরু করা হয়।
কয়রা সদর থেকে সড়ক পথে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুই নম্বর কয়রা গ্রাম। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে অবস্থিত ওই গ্রামটির ওপর পাড়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা। অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমির গ্রামের একমাত্র রক্ষাকবচ নদীর ওই বাঁধ। গত ২০ মে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে ওই বাঁধ মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রবল জোয়ারের পানির তোড়ে ভেঙে যায় স্লুইচ গেট সংলগ্ন বাঁধের বড় একটি অংশ। মুহুর্তেই তলিয়ে যায় দুই নম্বর কয়রা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলি। নদীর নোনা পানি চলে আসে উপজেলা সদরেও। পানির তোড়ে ভেঙে যায় সড়ক।
সড়কপথে ওই এলাকায় যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
দুই নম্বর কয়রা গ্রামের স্লুইচগেট সংলগ্ন বাঁধটির প্রায় ৮০০ ফুট কপোতাক্ষ নদের জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। ট্রলার যোগে ওই এলাকায় পৌঁছাতেই সেখানে জড়ো হন অর্ধশতাধিক উৎসুক মানুষ। নদীর পানিতে ঘর তলিয়ে যাওয়ায় বাঁধের ওপর বসে ছিলেন তাঁরা। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর যেন অভিযোগের খাতা খুলে বসেন। একের পর এক নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা করতে থাকেন তাঁরা। সেখানে ছিলেন হিন্দু, মুসলমান, নারী-পুরুষ সবাই।
এদের একজন বিজয় কুমার মণ্ডল। ঠিক যে স্থানে বাঁধ ভেঙেছে তার পাশেই ছিল তাঁর ঘর। ঝড়ে ঘরটি ভেঙে পড়ার পর জোয়ারের পানিতে তা তলিয়ে যায়। ঘরের আসবাবপত্র গুলো কোনো মতে রক্ষা করতে পেরেছেন তিনি। সেগুলো রাখা হয়েছে ভালো থাকা বাঁধের ওপর। বিজয় কুমার বলেন, ২০ মে ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাশ্রমে ভাঙন এলাকায় রিং বাঁধ নির্মাণে ঝাপিয়ে পড়েন এলাকাবাসী। প্রতিদিন সকালে জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার পর ভাটার সময় ওই বাঁধ নির্মাণের কাজ চলতো। সকালে কখন থেকে কাজ শুরু হবে তা মসজিদের মাইকে প্রচার করা হতো। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের দিনও কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। আর ওইদিন কাজ না করলে জোয়ারের পানিতে বাঁধ দেওয়া অন্য অংশও বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বাঁধ নির্মাণের কাজ চলাকালে দুই একদিন তমিজ উদ্দিনকে সবার সঙ্গে কাজ করতে দেখা গেছে।
স্বেচ্ছাশ্রমে যারা কাজ করেছেন তাঁদের জন্য সেমাইয়ের ব্যবস্থা করেন উপজেলা চেয়ারম্যান। আর দুপুরে খাওয়ার জন্য খেচুড়ির আয়োজন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এ কারণে ১১ টার দিকে কাজ শেষ হলেও সেখান থেকে কেউ যেতে চাননি। তাই সেখানেই ঈদের নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত হয়।
কাজের শেষে একই সময়ে মোট তিনটি ঈদের জামাত হয়। এর একটি ভাঙা বাঁধের উত্তর পাড়ে, অন্যটি দক্ষিণ পাড়ে ও আরেকটি জামাত হয় যেখানে এলাকাবাসী বাধ দিয়েছিলেন তাঁর পাশে জোয়ারের পানিতে।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাঁধের ওপর জামাত দুটির ইমামতি করেছিলেন কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির ও দুই নম্বর কয়রা গ্রামের মসজিদের ইমাম। আর ডাঙায় জায়গা না থাকায় পানিতে যে জামাতটি অনুষ্ঠিত হয় সেটির ইমামতি করেন তমিজ উদ্দিন। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে সবাই তাঁকে ইমামতি করার জন্য এগিয়ে দেন।
পানিতে ঈদের ওই জামাতে ছিলেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান। গত বছর অনুষ্ঠিত হওয়া উপনির্বাচনে সদর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঝড়ের পরদিন থেকেই এলাকার হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের কাজে লেগে পড়েন। ওই কাজে অংশগ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ। সময় না থাকায় সেখানে একই সঙ্গে তিনটি জামাতের সিদ্ধান্ত হয়। দুটি জামাত স্বল্প সংখ্যক মানুষকে নিয়ে বাঁধের ওপর হলেও জায়গা না থাকায় তৃতীয় জামাতটি হয় নির্মাণ করা বাঁধের পাশে জোয়ারের পানিতে দাঁড়িয়ে। তিনটি জামাতের সবগুলোর ছবিসহ বাঁধের কাজ করার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার ছবি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। এখানে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, বরং কয়রার মানুষের নিত্যদিনের যে দুর্ভোগ তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. আক্তারুজ্জামান খোকন বলেন, তমিজ উদ্দিন এলাকায় জামায়াত নেতা হিসেবে নয় এলাকার প্রবীন ও আলেম মানুষ হিসেবে ওইদিন মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে ইমামতি করেছেন। এটা নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতেছেন, তাঁরা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মুখে ফেনা তুলছেন, কাঁদা ছোড়াছুড়ি করছেন। এটা কয়রার আম্পান বিধ্বস্ত মানুষের কাছে খুবই বিব্রতকর। কয়রার মানুষ কাছে লবণপানি থেকে মুক্তি হওয়াটাই মূখ্য বিষয়, রাজনীতি নয়।