মোঃ আবদুর রহমান : আলোক ফাঁদ ধানের পোকা দমনের একটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। এ পদ্ধতিতে সন্ধ্যার পর ধান ক্ষেত হতে পঞ্চাশ থেকে একশ’ মিটার দূরে ফাঁকা জায়গায় বাঁশের তিনটি খুঁটি ত্রিকোণাকার করে মাটিতে পুঁতে মাথার অংশ একত্রে বেঁধে দিতে হয়। এরপর মাটি থেকে আড়াই থেকে তিন ফুঁট উপরে একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে খুঁটির তিন মাথার সংযোগস্থলে রশির সাহায্য ঝুলিয়ে দিতে হবে। এর নিচে একটি বড় আকারের প্লাস্টিকের গামলা বা পাত্রে ডিটারজেন্ট পাউডার অথবা কেরোসিন মিশ্রিত পানি রাখা হয়। সন্ধ্যার পর মাঠ জুড়ে যখন অন্ধকার নেমে আসতে থাকে তখন আলোক ফাঁদের আলোর ঝলকে আকৃষ্ট হয়ে ধান ফসলের বিভিন্ন পোকামাকড় এ পাত্রে চলে আসে ।
ইদানিং ধান ক্ষেতে বৈদ্যুতিক বাল্বের পাশাপাশি সৌর বিদ্যুতের আলোক ফাঁদও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এভাবে আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে ধান ফসলের মাঠে ক্ষতিকর ও উপকারী পোকামাকড়ের উপস্থিতি নির্ণয় পূর্বক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অতি অল্প খরচে তৈরি আলোক ফাঁদ অন্ধকার রাতে দেখতে দৃষ্টি নন্দনও বটে। এতে খরচ কম হয় এবং পরিবেশবান্ধব। তাই ধান ক্ষেতের ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতি শনাক্তকরণ ও দমনে আলোক ফাঁদ প্রযুক্তি রূপসার কৃষকদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
আলোক ফাঁদে উপকারী পোকার মধ্যে ড্যামসেল ফ্লাই, বোলতা, মাকড়সা, ক্যারাবিড বিটল, লেডি বিটল এবং ক্ষতিকর পোকার মধ্যে মাজরা পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, পাতা মোড়ানো পোকা ও বাদামি গাছ ফড়িং ( কারেন্ট পোকা ), সাদা পিঠ গাছ ফড়িং ও গান্ধি পোকার উপস্থিতি বেশি পাওয়া যায়।
রূপসা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে ধানের ক্ষতিকর ও উপকারী পোকামাকড়ের উপস্থিতি শনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এবছর রোপা আমন ধানে আলোক ফাঁদ স্থাপনের এক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে এ উপজেলার আইচগাতি, শ্রীফলতলা, নৈহাটী , টিএস বাহিরদিয়া ও ঘাটভোগ এই ৫ টি ইউনিয়নের ১৫ টি ব্লকের বিভিন্ন জায়গায় একযোগে প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় আমন ধান ক্ষেতের পাশে বৈদ্যুতিক ও সৌর বিদ্যুতের আলোক ফাঁদ স্থাপন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর উদ্বোধন করেন উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব মোঃ ফরিদুজ্জামান । স্ব-স্ব ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ কৃষকদের সাথে নিয়ে আলোক ফাঁদ স্থাপনের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন ।
রূপসা উপজেলার আলাইপুর গ্রামের কৃষক ইসলাম সরদার, আঃ রাজ্জাক শেখ, আঃ কাদের শেখ ও অহেদ সরদার জানান, ধান ক্ষেতে আলোক ফাঁদ ব্যবহারের মাধ্যমে উপকারী ও ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতি চিহ্নিত করে ক্ষতিকর পোকা দমন করা সহজ হয়েছে। কৃষক ইসলাম সরদার বলেন, এ পদ্ধতিতে আমরা আগের চেয়ে কম খরচে ক্ষতিকর পোকা দমন করে ফসল রক্ষা করতে পারছি । আবার উপকারী পোকাও বাঁচাতে পারছি। এতে করে আমাদের উৎপাদন খরচ কমছে।
একই গ্রামের কৃষক লুৎফর রহমান, আতিয়ার পাইক, মোহাম্মদ মিনা ও মনিরউদ্দিন শেখসহ অনেকেই বলেন, আগে আমরা আলোক ফাঁদ কী জানতাম না। কিন্তু রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে পরিবেশবান্ধব এই কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমানে আমরা নিজেরাই রোপা আমন ধানের জমির ক্ষতিকর পোকা চিহ্নিত করে কৃষি অফিসের পরামর্শক্রমে সঙ্গে সঙ্গে বালাইনাশক ব্যবহার করে পোকা দমন করতে পারছি। এতে করে আমাদের উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে , অপরদিকে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা পাচ্ছে।
এ বিষয়ে রূপসা উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আবদুর রহমান বলেন, আমার ব্লকের বিভিন্ন জায়গায় কৃষকদের নিয়ে প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় আলোক ফাঁদ স্থাপন করছি। এ ফাঁদের মাধ্যমে ধানের জমিতে বর্তমানে কী কী ক্ষতিকর ও উপকারী পোকামাকড় রয়েছে তা শনাক্ত করে ক্ষতিকারক পোকা দমনে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এটি পরিবেশবান্ধব পোকা দমনের একটি সহজ পদ্ধতি। রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব মোঃ ফরিদুজ্জামান জানান , ক্ষতিকর পোকামাকড় বিশেষ করে বিপিএইচ বা কারেন্ট পোকা যাতে রোপা আমন ধানের ক্ষতি সাধন করতে না পারে এবং কৃষকরা সঠিক সময়ে যেন পোকা দমনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সেজন্যই এ উপজেলার ১৫ টি ব্লকে একযোগে প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় আলোক ফাঁদ স্থাপনের এ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে এবং ধান পাকা পর্যন্ত তা চলতে থাকবে । তিনি আরো বলেন, ধানের জমিতে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপস্থিতি নির্ণয় করতে আলোক ফাঁদের বিকল্প নেই।
পোকামাকড় রোপা আমন ধানের প্রধান শত্রু । এসব পোকামাকড় দমনে যথেচ্ছভাবে মাত্রাহীন পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারে আমাদের জীববৈচিত্র্য , পরিবেশ, পশুপাখি ও মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কীটনাশকের এই ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রোপা আমন ধান রক্ষা করতে আলোক ফাঁদের মতো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, যা আমন ধানের জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে সাহায্য করবে। এজন্য এ প্রযুক্তির ব্যবহার ও উপকারিতা সর্ম্পকে কৃষকদের মাঝে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক।
লেখকঃ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি অফিস , রূপসা, খুলনা।