ইমতিয়াজ উদ্দিন, কয়রা : বুকভরা আশা নিয়ে তিন একর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার কৃষক আসাদুল ইসলাম। কয়রা সদরের ওড়াতলা এলাকার এই কৃষক কয়েক দিন আগেও সোনালি ধান ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তান্ডবে সে স্বপ্ন এখন ফিকে হয়ে গেছে। সংসার পরিচালনার সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে তার। ঝোড়ো বাতাসে ধানগাছগুলো সব লুটিয়ে পড়েছে পানিতে। জমির দিকে তাকালে কান্নায় বুক ভেঙে যাচ্ছে বলে জানালেন তিনি।
উপজেলার মহারাজপুর এলাকার কামাল হোসেনও প্রতিবেশী শামীম শেখের নিকট থেকে জমি লিজ নিয়ে দুই একর জমিতে আমন ধানের চাষ করেছিলেন। সাথেই ছিলো মাছের ঘের। বুলবুলের ছোবলে মাছের ঘের আর ধানের ক্ষেত দুটোই পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
আসাদুল ইসলাম আর কামাল হোসেনের মতো কয়রার বহু কৃষক, মৎস্য খামারিসহ গ্রামের দরিদ্র লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বুলবুলের ছোবলে। বিশেষত এই অঞ্চলের কৃষকদের মাথায় হাত দিয়ে হতাশা ও দুশ্চিন্তায় সময় ক্ষেপণ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নাই।
উপজেলাটির পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী কয়রার মোট ৪০ হাজার কৃষক পরিবারের অধিকাংশই বুলবুলের ছোবলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলার ভারপ্রাপ্ত পরিসংখ্যান অফিসার শেখ আব্দুল মজিদ জানান, তাদের হিসেবে এ মৌসুমে কয়রায় মোট ৩৭হাজার ৩শত ২একর জমিতে আমন ধানের চাষাবাদ হয়েছিল। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫৫ হাজার ৪শত ৯০ মেট্রিকটন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তান্ডবে অধিকাংশ জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে।
কয়রা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিজান মাহমুদ জানান, “ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে আমরা এ পর্যন্ত ১৭২০ হেক্টর জমির আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পেয়েছি। এরমধ্যে ১৫০ হেক্টর জমির ধান পুটরোপুরি পানিতে নিমজ্জিত, ৭৫০ হেক্টর জমির ধান গাছ সম্পুর্ণরুপে হেলে পড়েছে এবং ৮শত হেক্টর জমির ধানের ফুল ঝরে পড়েছে। এছাড়া
উপজেলাটির ২০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ কৃত সবজির ৮৫ ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৫৫০ হেক্টর জমিতে চাষকৃত ফলের ১৬৫ হেক্টর জমির ফলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান কয়রা উপজেলার এই কৃষি কর্মকর্তা।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় ও অতিমাত্রায় বৃষ্টিতে কয়রার ৩ হাজার ২৬০ টি মৎস্য ঘের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। যার আয়তন ৩৩শ হেক্টর।
গত ১০ নভেম্বর রোববার রাত সাড়ে তিনটার দিকে কয়রা উপজেলার উপর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। টানা পাঁচ ঘন্টা চলে প্রলয়। শেষ হয় সকাল সাড়ে আটটার দিকে। এতেই পাল্টে গেছে কয়রা উপজেলার চেহারা।
ঝড়ে ফসল ও মৎস্য ঘরের ক্ষতির পাশাপাশি বহু ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়াগেছে। কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল কুমার সাহা জানান,কয়রা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ২ হাজার ৩শত ঘরবাড়ি একেবারেই বিদ্ধস্ত হয়েছে। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৮শত ঘর।
কয়রার ঘাটাখালী এলাকার কৃষক আবু তৈয়েব জানান, ঘাটাখালী এলাকার মাঠের অনেক জমির আমন ধান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “আর কিছু দিন পরেই আমার আমন ধান কাটা যেত। কিন্তু ঝড়ের কারণে সব ধান গাছ পানিতে ডুবে গেছে। এখন তো গরিব কৃষকদের সর্বনাশ হয়ে গেল। ঝড়ে আমার একটা ঘরও পড়ে গেছে।”
একই এলাকার আবুল কাশেম জানান, তার আট বিঘা জমির ধানে কেবল ফুল এসেছিল । কয়েক সপ্তাহর মধ্যেই এটা ঘরে তোলা যেত। কিন্তু ঝড়ে সব ধান ক্ষেতে শুয়ে পড়েছে।
তবে ধান গাছ যেন নষ্ট না হয় সেজন্য কৃষকদের কয়েকটি ধানগাছ একসঙ্গে গোছা বেঁধে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে। এ পদ্ধতিতে ডুবে যাওয়া ধানগাছ পচন থেকে রক্ষা করা যাবে। তবে ফুল ঝরেপড়া গাছগুলোর ধানের ভেতর চালের বদলে চিটা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে বলে জানান উপজেলা কৃষি অফিসার মিজান মাহমুদ।
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তদন্ত করে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। আগামীতে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাটিতে সরকারি সহযোগিতা অব্যহত থাকবে বলে জানান তিনি।