আবুল কালাম রহমান
একটি বিশেষ কাজে বিমল গত সপ্তাহে ঢাকায় যায়। এক সপ্তাহ পর বিমল ঢাকা থেকে বাস যুগে এসে তাদের স্থানীয় বাজারে নামে। বিমল নেমেই প্রথমে মাছ বাজারে চলে যায়। মাছ বাজার গিয়ে বাজারের সব চেয়ে বড় বোয়াল মাছটি কিনে নেয়। এরপর শাশুড়ি আম্মাজানের জন্য একটি টাঙ্গাইলি কাপড় কিনেন। এবং শালীদের জন্য ভাজা বুট, বাদাম ও পাপন কিনে শ্বশুর বাড়ির উদ্ধেশ্য রওয়ানা দিলেন। বাজার থেকে শ্বশুর বাড়ি হেটে যেতে মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিটের পথ। শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার আগে বিমল তাঁর স্ত্রীকে ফোন করে জানায়। বিমলের আগমনি কথা শুনে তাঁর স্ত্রী ও শালী সবাই আনন্দে আত্বহারা। তারা দা, কুঠার, চাক্কু নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো। বড় বোয়াল মাছটি আজ সবাই মিলে কাটবে। শালীরা আজ তাদের দুলা ভাইয়ের সাথে লুডুও খেলবে। সেবার যখন বিমল এসেছিলো, তখন তারা রাত জেগে লুডু খেলে। অনেক আনন্দও করে। আজও সেই রকম আনন্দ হবে।
বিমল হেটে যাচ্ছে। রাত তখন এগারোটা হবে। রাস্তার দু’ধারে সাঁড়ি সাঁড়ি গাছ। আকাশে ঘন মেঘ। মাঝে মাঝে টিপ টিপ শব্দে বৃষ্টিও পরে। বাতাসে মেঘ যখন কেটে যায় তখন একটু চাঁদের আলো বিমলের জন্য বড় আশার আলো নিয়ে আসে। সেই আলোতে কিছুটা পথ ভালো ভাবে চলতে পারলেও মেঘ যখন আবার চাঁদকে ঘিরে ফেলে তখন তাঁর পথচলতে কষ্ট হয়। কখনো কখনো ভুল করে কাঁদা যুক্ত গর্তে তাঁর পা চলে যায়। আর গর্তে যখন পা পরে তখন তাঁর এতোটাই বিরক্তিকর হয় যে, ইচ্ছে হয় তখন শ্বশুর বাড়ি না গিয়ে নিজ বাড়িতে উঠার! গর্তে পা পরলে বেচারার সখের জামা, প্যান্ট আর জুতোর অবস্থা খুবই নোংড়া হয়ে পরে। যদিও রাতের আঁধারে পোশাকের অবস্থা দেখা যায় না। কিন্তু তাঁর মন বলছে কি অবস্থায় আছে শ্বশুর বাড়ি থেকে পাওয়া মহা মূল্যবানের পোশাক।
শ্বাশুড়ি আম্মাজানের জন্য পুঁথি কাপড়, স্ত্রীর জন্য বড় বোয়াল মাছ, শালীদের জন্য গরম মজাদার খাবার। এতো কিছু নিতে পেরে আজ বিমল অনেকটাই আনন্দিত! গর্বিত! উৎফল্ল। মনে মনে সে কতো ভাবনা, চিন্তা আর পরিকল্পনা করে আনমনে হেটে চলেছে। আর বেশি দূর নয়। সামনে একটি তিন রাস্তার মুখ। ওখানে গিয়ে হাতের ডান পাশের যে রাস্তা, সেখান থেকে একটু ভীতরে গিয়ে হাতের বাম পাশেই তাঁর শ্বশুরের বাড়ি। বিমল চাইলে সামনের রাস্তা দিয়েও যেতে পারতো। অবশ্যই সেখান দিয়ে গেলে তাকে অনেকটা পথ হাটতে হতো। বৃষ্টি বাদলের রাত তাই বিমল ওতো দূর না গিয়ে স্বল্প সময়ে এই দিক দিয়ে যাওয়াটা সে আজ শ্রেয় মনে করলো। আসলে বিমল এ গ্রামেরই ছেলে। তার এসব অপরিচিত নয়। বেচারা রাতে আসার একটাই কারণ, যদি গ্রামের কেউ দেখে, বা বাড়ির কেউ তবে তার পরিবারকে জানাবে। আর জানাজানি হলেই বিপদ।
বিমল তিন রাস্তার মুখে এসে ডান দিকে অগ্রসর হলো। আর বেশি দূর নয়। কিছুক্ষন পরেই শ্বশুর বাড়িতে উঠবে। শ্বশুর ঘরে গিয়ে বউয়ের হাতে বোয়াল মাছ তুলে দিবে। শাশুড়ি আম্মাজানের হাতে কাপড় দিবে। শালীদের হাতে তাদের খাবার তুলে দিবে। সবাই কত খুশি হবে। এতো কিছু নিতে পেরে বিমল নিজেকে মনে মনে ধন্য মনে করলো। নানান রকম ভাবনা নিয়ে পথচলতে থাকলো।
চলার পথে হঠাৎ বিমল দাড়িয়ে পরলো। মনে হলো কে জেনো তাকে ডাকছে। সে দাড়িয়ে চারপাশ নজর দিয়ে দেখলো কেউ নেই। কিন্তু কণ্ঠ তাঁর খুব পরিচিত কারো মনে হলো। যদিও মনে করতে পারছে না। ভাবলো হয়তো তাঁর শুনার ভুল। তাই কারো সাড়া শব্দ না পেয়ে বিমল আবার সামনের দিকে অগ্রসর হলো।
রাস্তার দু পাশে ঝোপঝাড়, গাছ গাছালী ভরা। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশ হতে, গাছ হতে, জঙ্গল হতে বিভিন্ন রকম ভয়ানক শব্দ আসতে থাকে। অপর দিকে ব্যাঙের শব্দেও কেমন জানি অন্য রকম হতে থাকলো বিমল।
এমন অবস্থায় বিমল হাটার গতি বাড়াতে থাকলো কিন্তু যত দ্রুতই পথ এগুচ্ছে ততোই যেন পথ দীর্ঘ হচ্ছে।
কিছু পথ যাওয়ার পর বিমল রাস্তার একপাশ থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেলো। মনে হলো কোনো বাচ্ছার কান্না। কিন্তু এই রাস্তা দিয়ে মানুষ তেমন চলাফেরা করে না। এখানে এ অসময় বাচ্ছা আসারও কোনো যুক্তি খুজে পাচ্ছে না বিমল। সে এবারও মনে করলে এটি তাঁর শুনার ভুল। তাই আবারও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলো কিন্ত এবার আর যেতে পারছে না। কারণ, বিমল সামনের দিকে যত পা বাড়ায় কান্নার শব্দ ততই বাড়ে যায়।
“যেয়েও না, আমাকে নিয়ে যাও, আমি একা, প্লিজ! আমার খুব ভয় করছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলব” বলে আসা এই আওয়াজ গুলো বিমলের মনে দয়ার জন্ম নিলো। বিমল এই অবস্থায় অনেক চিন্তিত হয়ে পড়লো। অপর দিকে তার হাতপাও কাপছে। হাতে থাকা মাছের থলি, শালীদের জন্য নেয়া খাবার ইচ্ছে হয় তার ছুড়ে ফেলে দিতে কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে বলে বিমল এবার যেখান থেকে শিশুর কান্নার শব্দ আসতে লাগলো সেখানে গিয়ে শিশুটিকে খুজতে থাকলো। কিন্ত কোথাও বাচ্ছাটিকে দেখতে পেলো না। কোনো সারা শব্দও পেলো না। মূহুর্তের মধ্যেই সব নীরব হয়ে গেলো। বিমল এবার আরো ভয় পেয়ে গেলো।
“হচ্ছেটা কি এসব! এমন তো হওয়ার কথা না। এর আগেও তো আমি এই পথ দিয়ে আসা যাওয়া করেছি। এই সময়েও। কই তখন তো এমন হয়নি। আজ এমন হচ্ছে কনো? সে নিজে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকলো।
ভয়ে তাঁর যেন গলা শুকিয়ে আসছে। তবুও বিমল সামনের দিকে রওয়ানা দিলো। কয়েক পা বাড়াতেই আবার সেই কান্না সুরে ডাকা শুরু হলো,
“যেয়েও না তুমি, এই তো আমি। অন্ধকারে তুমি আমাকে দেখতে পাওনি। মেঘ কেটে গেছে। চাঁদের আলো ধব ধব করছে। এবার ফিরে তাকাও। আমাকে দেখতে পাবে।” বলে বিনয়ের সুরে ডাকতে থাকলো বিমলকে।
এই মধুর ডাক বিমলকে পাগল করে দিলো। বিমলের মনে দয়া হলো। সে আবার খুঁজতে থাকলো। এবার আর বিমলকে কষ্ট করতে হলো না। চারদিকে তাকিয়ে খুজতে হলো না। যার জন্য বিমল এই মধ্য রাতে আটক হয়ে আছে সে নিজেই বিমলের সম্মুখে হাজির।
এই কি? এতোক্ষন শুনলো কিসের আওয়াজ আর এখন তার সামনে দেখছে কি?
বিমল তো ইহার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। বিমলের যেন ধম বন্দ হয়ে আসছে। চোখ যেন বড় হয়ে বের হয়ে আসছে। গলা যেন শুকিয়ে আসছে। সে এই অবস্থার জন্য তো কখনোই প্রস্তুত ছিলো না। তার সামনে মাটিতে পরে আছে, একটি ছাগলের বাচ্ছা! তার একটি চোখ বাতির মত জ্বলছে! আরেকটি দেখা যায় না! কানও নেই। পেছনে লেজও নেই! গায়ের পশম গুলো অনেক বড় হয়ে ঝঁট বেধে আছে। । কি অদ্ভুত। জীবনেও এমন ছাগল ছেনা সে আর কখনো দেখেনি। ছাগলের গলায় একটা রসিও আছে। এমনটি দেখে সে মহা চিন্তায় পরে গেলো। এই নীরব নির্জন এলাকায়, এই ছাগল কে রেখে গেলো? আর এমন হলেও বা কি করে? শুনলাম মানুষের বাচ্ছার কান্না আর এখন দেখছি অদ্ভুদ ছাগলের বাচ্ছা। কোনো পেত্নী, রাক্ষস বা ভূতের খপ্পরে পরিনি তো বলে মনে মনে নিজে নিজেকে প্রশ্নঃ করতে থাকলো।
সে দাড়িয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলো। ছাগলটি সাথে নিয়ে যাবে না যাবে না?
পরোক্ষণে ভাবলো, এই ছাগল রেখে গেলে সে আবার পিছন থেকে ডাকবে। এতে করে বিমল বিভ্রান্তিতে পরে যাবে। তার চেয়ে সাথে করে নিয়ে যাওয়াটাই উত্তম হবে, বলে বিমল মনে করলো।
তাঁর দুই হাতে থাকা দু’টি থলি এক হাতে নিয়ে নিলো। আরেক হাতে ছাগলের রসি নিয়ে পেছনে ছাগলের বাচ্ছা সামনে বিমল হাটতে থাকলো।
ছাগলের বাচ্ছাটি সঙ্গে নেওয়ার সাথে সাথে পরিবেশও শান্ত হলো। বৃষ্টি পরা পুরাই বন্দ হয়ে গেলো। যদিও মেঘ এখনো আকাশে খেলা করছে। তাই চাঁদের আলোও আসা যাওয়া করছে। এতে কিন্তু বিমলের পথ চলতে একটুও কষ্ট হয় না। বরং সে চাঁদের আলোয় আনমনে পথ চলতে থাকলো।
যে সময়ে শ্বশুরঘরে উঠার কথা সে সময় আর হলো না। একটু দেরিই হলো বটে। তবে এতে বিমলের মনে একটুও দুঃখ নেই। সে অনেকটাই খুশি। কারন তাঁর সাথে থাকা এই অদ্ভুত ছাগলের বাচ্ছাটি তাঁর শালীদের জন্য নিয়ে যাবে। শালীদের ভয় দেখাবে। বিমল মনে মনে এসব চিন্তা করছে আর মিন মিন করে হাসছে।
কিছুক্ষণ হাটার পর তাঁর হাতে নরম তুলোর মত অনুভব হলো। হাতে থাকা রসিটা যেন কোনো পশম যুক্ত বিড়ালের লেজ মনে হলো। আবার বিমলকে ছেড়ে যাবারও প্রাণপন চেষ্টা। বিমল একটু বিঘড়ে গেলো। রসিটা হটাৎ এমন লাগছে কেনো! বিমল মনে মনে ভাবতে ভাবতে কৌতহল নিয়ে পিছনের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বিমল হতভম্ব হয়ে গেলো। চোখ তাঁর কপোলে উঠার মত হলো। ভয়ে দুই ঠোঁট এতোটাই কাপতে থাকলো যে এক ঠোঁট আরেক ঠোঁটের সাথে মিলাতে অসম্ভব হয়ে পরছে। ঠোঁটের কাপন, হাতের কাপন, ধুক ধুক শব্দে বুকের কাপন বিমল অস্থির হয়ে পরলো।
আর এমন না হয়েও বা উপায় আছে? যে ছাগলের বাচ্ছাকে দয়া দেখিয়ে সাথে নিয়ে নিলো, সেটি এখন হনুমান। বিমল ধরে আছে হণুমানের লেজ। আর হনুমান বিমলকে ছেড়ে যাবার চেষ্টা করছে। এটি কোনো সাধারণ হনুমানেরর মত নয়। ইয়া বড় মাথা। বড় বড় কান। মাথার চুল গুলো যেন গাছের লতা। এক একটি পা যেন এক একটি হাতির পা! আঁকার হনুমান হলেও তার অঙ্গ বহু জন্ততে রূপ ধারন করে আছে।
বড় বড় দাঁত, পেত্নীর মত মুখ মন্ডল নিয়ে যখন বিমলের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো তখনি বিমল হনুমানের লেজ ছেড়ে দিয়ে শরীরের পুরো শক্তি নিয়ে একটা দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসলো।
কিছু দূর যাওয়ার পর বিমলের সারা দেহ জিমিয়ে পড়লো। ত্রিশ চল্লিশ মিনিটের পথ বিমলের কাছে যেন কয়েক ঘন্টা মনে হতে থাকলো। দৌড়ে আসতে আসতে বিমল ক্লান্ত হয়ে পরলো। একটু বসার প্রয়োজন। চারদিক নজর দিয়ে দেখলো কোথাও বসার জায়গা নেই। এখন চাঁদের আলো কিছুটা প্রকৃতির ধারনা করতে পারছে। পাশে একটি বড় গাছের দিকে চোখ পরলো। ধীরে ধীরে হেটে গিয়ে সেই গাছের নিচে বসলো।
আজ এমন হলো কেনো? পূর্বেত কখনো আমার এমন হয়নি। কত সখ করে শাশুড়ির জন্য কাপড় কিনেছি, বৌয়ের জন্য বাজারের সব চেয়ে বড় মাছ কিনে নিয়েছি। শালীদের জন্য তাদের পছন্দের খাবার নিয়েছি। কত আনন্দই না আজ করার কথা। আর হলো কি? কিছুই বুঝে আসে না। সবাই তো এতোক্ষনও আমার আশায় বসে আছে। ওহ! কখন যে পৌছবো বুঝতে পারছি না। রাত প্রায় একটা। বিমল গাছের নিছে বসে একা একা আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে চিন্তা করতে থাকলো।
ভয় আর ক্লান্তিকর ভাব যখন দূর হলো তখন আবার রওয়ানা হলো শ্বশুর বাড়ীর উদ্দেশ্যে। সামনে পা বাড়াতেই গাছের একটি শিখরে উস্ঠা খেয়ে পরে। ওষ্ঠায় বিমল থমকে দাঁড়ালো। উপরের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে সে এবার যা দেখলো, তা বিশ্বাসী করতে পারছে না। বিশ্বাস করতে পারছে না বিমল এতক্ষণ কি করে এখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। তাও আবার রাত প্রায় একটা। এতোক্ষন সে যে স্থানে বসা ছিলো সেটি ছিলো একটি তেতুল গাছ। এ তেতুল গাছকে ঘিরে অনেক ইতিহাস আছে। এ তেতুল গাছ অনেক কিছুর সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক অদ্ভুধ ঘটনা জন্মদান কারী এ তেতুল গাছ।
এই সেই তেঁতুল গাছ যেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো স্বরণ হলেই গা শিয়রে উঠে। কত মানুষ তাঁর ছায়া থেকেও দূরে থাকতে বিপরীত রাস্তা দিয়ে হেটে যেতো। মানুষ জন নেই। পশু পাখি নেই। অথচ, কেউ তার পাশ দিয়ে হেটে গেলেই ডাক দিতো! গাছ ডাকে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখলে কার না ভয় পায়? কেউ হেটে যাচ্ছে হঠাৎ পেছন থেকে খাপটি দিয়ে ধরে ফেলে। যেনো মানুষের হাত। পরোক্ষনে দেখা যায় জনশূন্য পরিবেশ। নীরব দাঁড়িয়ে আছে তেতুল গাছ।
একদিন এক মহিলা ক্লান্ত হয়ে এই গাছের গোড়ায় বসেছিলো তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে বিশ্রামের জন্য। কিছুক্ষণ পর মহিলা ঘুমিয়ে পরে। ঘুম ভাঙলে দেখে পাশে তার শিশু সন্তান নেই। এই দিক সেই দিক তাকিয়ে খুঁজ করলো। কোথাও তাঁর সন্তানের খোঁজ মিললো না। সন্তানের খোঁজে মহিলা যখন প্রায় অচেতন, তখন লম্বা দুটি হাত মহিলার সামনে তার সন্তান নিয়ে হাজির। তাও আবার মানুষ বিহীন। এমন দৃশ্য দেখে কোনো রকম বাচ্ছাটি নিয়ে মহিলা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
এই তেতুল গাছের অদৃশ্য শক্তির কবলে বিমলও পরেছিলো একবার। প্রায় দুই মাস পূর্বে বিমলদের একটা গরু মারা যায়। গরুটি কোথাও পুঁতে রাখার জায়গা না পেয়ে বিমল ও তাঁর এক বন্ধু সাহস করে এই তেঁতুল গাছের নিচে গর্ত করে মাটি চাপা দিয়ে চলে যায়। এর কয়েকদিন পর যখন বিমল এই গাছের নিচ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো তখন হঠাৎ উপর থেকে কি যেন একটা তাঁর পাশে পরলো। এমন ভয়ানক শব্দ দিয়ে পরলো যে তা না দেখেও উপায় নেই। বিমল পাশে নজর দিতেই তাঁর সারা শরীর কেঁপে উঠলো। সে নিজকেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না এ কি দেখছে তখন? যে গরুটি নিজ হাতে মাটি চাপা দিয়ে গেলো সেই গরুর আস্ত বড় মাথা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়ে নয় মাথাটি বলের মত লাপাচ্ছে, দৈত্যের মত বড় বড় শব্দ করে হাসছে!
বিমল এই রূপ দেখে ভীশন ভয় পেয়ে কোনো রকম দৌড়ে পালিয়ে যায়। সেই যে গেলো আর ভুল করেও এই পথে আসা যাওয়া করেনি। কিন্তু আজ কি ভাবে এ পথে আসলো, আবার সেই ভয়ংকর তেঁতুল গাছের নিচেও বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। মাথায় কাজ করছে না তাঁর!
যে গাছ পথচারিদের শান্তি দেয় না। সেই গাছের নিছে আসা মাত্র সব কিছু শান্ত হয়ে গেলো। মনের ভয় দূর হয়ে গেলো। আকাশে আর মেঘ নেই। চাঁদের আলোও ধব ধব করছে। বিমল যেন রাক্ষসের ঘরে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে আজ। এতসব ভাবনা বিমলকে বাকরুদ্ধ করে ফেললো।
সব ভুলে বিমল সামনের দিকে অগ্রসর হলো। আর সামান্য একটু পথ হেটে গেলেই শ্বশুর বাড়ি। হাটতে লাগলো। হাটতে হাটতে এবার চলে এলো শ্বশুর বাড়ির রাস্তার প্রবেশ মুখে। এখানে এসে একটু দাঁড়ালো। চাঁদের আলোয় দেখার চেস্টা করলো গ্রামের বা বাড়ির কেউ চলাফেরা করে কিনা। যদি দেখে বিপদ ঘটবে। বিমল বরাবরই এই দিক থেকে সতর্ক।
যাক বিমল এবার তাঁর হাতে থাকা থলি মাটিতে রেখে পা থেকে জুতো দুটি বের করে পরিস্কার করলো। প্যান্টে লেগে থাকা কাঁদাও পরিস্কার করলো। হাতে থাকা ঘরিতে নজর দিয়ে দেখে, রাত প্রায় দেড়টা বাঁজতে চলেছে। সময় দেখে একটু বিচলিত হলো। বিচলিত না হয়েও উপায় নেই। কারণ, এই পথে আসতে বড় জোর যেখানে সময় ত্রিশ থেকে থেকে চল্লিশ মিনিট লাগে, সেখানে সময় লেগে গেলো প্রায় আড়াই ঘন্টা!
মাটি থেকে মাছের থলি ও শালীদের জন্য আনা খাবার, শাশুড়ি আম্মাজানের জন্য নিয়ে আসা কাপড় হাতে নিয়ে শ্বশুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো।
তার জীবনের একটি অদ্ভুত রাতের জন্ম হলো আজ। যতদিন বাঁচবে সে আর এই পথে আসবে না বলে মনে মনে শপথ করলো।
আজ শশুড় বাড়ির সবাইকে এই ভয়ানক ঘটনাটা শুনাবে। সবাইকে ভয় পায়ে দিবে। তাঁর ধৈর্য ও শাহসের কথাও সবাইকে বলবে।
শশুর ঘরের থেকে কিছু দূর থাকতেই চলতি পথে বিমল আচমকা দাঁড়িয়ে গেলো। সে এবার দেখতে পেলো, সামনের দিক থেকে তার দিকে দুটি বিড়াল খুব তেড়ে আসছে। অদ্ভুদ কান্ড! তাঁর শ্বশুর বাড়িতে কোনো বিড়ালই নেই। আবার এ বিড়াল সাধারণ বিড়ালের মতও নয়। একটি বিড়াল দেখতে বাঘের বাচ্ছার মতই। বিড়ালটির কণ্ঠস্বর হুবহুব বাঘের গর্জনের মত বিকট শব্দ করতে থাকলো।
আর অপর বিড়ালটি তাকে পেত্নীর মত শব্দ করে বলছে, “পালিয়ে যা আর না হয় আমরা তোকে খেয়ে ফেলবো হা হা হা”।
তাদের কথা বিমলের মনে অনেক ভয় ধরিয়ে দিলো। বিড়াল দুটির চোখে তাকিয়ে তাকা সম্ভব হচ্ছে না। কি কুৎসিত আর বিভৎস রূপ ধারন করে একেকটা তা বলার মত নয়।
বড় বড় দাঁত। পেশাচি রূপ। মুহুর্তে রঙ বদলানো দেখে বিমল ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। শেষমেশ এই দুটি জন্তুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য পালানোর পথ-ই বেচে নেয়। “যে ভাবনা, সেই কাজ”। তাঁর পাশেই একটি ঘর আছে ঘরটি তাঁর চিরচেনা। খুব পরিচিতও। সে দৌড়ে রাস্তার পাশে থাকা ঘরটির দরজার সামনে গিয়ে কলিং বেল ভাজাতে থাকলো। একদিকে প্রান বাঁচার প্রাণপন চেষ্টা অন্যদিকে দরজা খুলতে দেরী। দুটিই বিমলকে যেন অস্থির করে ফেলছে। একটু পরেই দরজাটা খুলে গেলো।
বিমল হুট করে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো।
যে দরজা খুলে দিলো বিমল তাঁর চোখে চোখ রেখে খুব লজ্জিত হয়ে গেলো। নিজেকে খুব ঘৃন্নিত মনে করলো।
লজ্জা, ঘৃনায় বিমল কি করবে বুঝতে পারছে না। তবুও সে খুব বিনয়ের সাথে বললো, “আমি খুবই অনুতপ্ত, লজ্জিত, আমি আসার আগে তোমাকে কল করে জানায়নি বলে। এ বাজার গুলো রেখে দাও। আর কখনো এমন হবে না। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দাও মা”।
আবুল কালাম রহমান
হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।
+248 2544011