সুন্দরবন উপকূলীয় উপজেলায় করোনা প্রতিরোধে প্রস্তুতি

প্রকাশঃ ২০২০-০৩-২৯ - ১৯:০৩

ইমতিয়াজ উদ্দিন : খুলনার সর্বদক্ষীনে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলাটির নাম কয়রা। আগের যে কোন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কয়রা এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়াতো বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। সিডর, ফনী, বুলবুলের সময় বুক চিতিয়ে লড়ে যাওয়া অপরাজেয় সুন্দরবনও যেন করোনা ভাইরাস আতঙ্ক থেকে উপকূলীয় উপজেলাটির মানুষকে রক্ষা করতে অপারগ। কয়রার লোকায়কে সুন্দরবনের থেকে আলাদা করেছে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদী। করোনা আতঙ্কে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলে বাওয়ালীরাও ঘর ছেড়ে নদী পার হয়ে বনে যাচ্ছেনা । রাস্তাগুলো ধু ধু করছে। একেবারেই ফাঁকা। এই জনশূন্য রাস্তাগুলোই প্রকাশ করছে কয়রার মানুষের ঘরবন্দী জীবনের দীর্ঘশ্বাস। আতঙ্কের লুকানো হাহাকার। করোনার থাবা গোটা দেশের মতো কয়রার মানুষকেও আত্মরক্ষার শৃঙ্খলে আটকে ফেলেছে। সবাই ঘরে বসে বসে অপেক্ষা করছে, কখন করোনার দুঃসময় কাটবে! প্রশাসনের পক্ষ্ থেকেও করোনা প্রতিরোধে উপকূলীয় উপজেলা কয়রায় নেয়া হয়েছে প্রস্তুতি। সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলিও ব্যাপক তৎপর।
বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে ২১৭ জন :
খুলনা জেলার সর্বচ্চ বিদেশ ফেরত মানুষ উপকূলীয় উপজেলা কয়রায়। ২৯ মার্চ রবিবার পর্যন্ত মোট বিদেশ থেকে ফিরেছেন ২১৭ জন। সবাই নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। এর মধ্যে ১৪ দিন শেষ হয়ে যাওয়ায় ৭২ জনের বাড়িতে থাকার বাধ্যবাধকতা শেষ হয়েছে। খুলনা জেলা সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
করোনা প্রতিরোধে কয়রার স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি :
কয়রায় করোনা ভাইরাসের কোনো রোগী না থাকলেও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ইতিমধ্যে হাসপাতালে পুরুষ-মহিলার জন্য কোয়ারেন্টাইন রুম বরাদ্দের পাশাপাশি আইসোলেশন রুমও বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে বেড সংখ্যা বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুদীপ বালা বলেন, কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ৯ জন ডাক্তারসহ সকল স্টাফ হাসপাতালে রয়েছে। তবে রোগীদের চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার সরঞ্জামের ঘাটতি থাকায় সবাই কিছুটা আতঙ্কে আছেন।হসপিটালটিতে জ্বর, সর্দি ও কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের আলাদাভাবে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
করোনা প্রতিরোধে কয়রায় প্রশাসনের তৎপরতা
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে খুলনার কয়রা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক সতর্কতামূলক তৎপরতা শুরু হয়েছে। দিনভর বিভিন্ন ইউনিয়নে মাইকিং করে জনগণকে সতর্কতামূলক দিক নির্দেশনা দেয়া অব্যাহত আছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দোকান ব্যতীত সকলপ্রকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল কুমার সাহা জানান, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে করোনা প্রতিরোধে সার্বিক কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম সহ মনিটরিং সেল খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে উপজেলার ৭ টি ইউনিয়নের সাপ্তাহিক হাট বাজারে গণ জমায়েত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অসাধু ব্যবস্যায়ীরা এ সুযোগে যাতে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে না পারে সে লক্ষ্যে মূল্য নির্ধারণ করে দোকানে চার্ট টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সংক্রামক যাতে না বিস্তার ঘটে সে লক্ষ্যে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া সকলকে লগইন করে দেওয়া হয়েছে। তবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল নিয়ম মেনে চলা ও আতঙ্কিত না হওয়ার আহব্বান জানিয়েছেন তিনি।
প্রশাসনের কড়া নজরে বিদেশ থেকে আসা লোকজন
কয়রা উপজেলায় এখনও পর্যন্ত ২১৭ জন বিদেশ ফেরতকে রাখা হয়েছে প্রশাসনের কড়া নজরদারিতে। বিভিন্ন দেশ থেকে যাঁরা কয়রায় ফিরেছেন তাঁদের চিহ্নিত করে এবং নজরবন্দি করতে বাড়ির সামনে পাহারায় বসানো হয়েছে সিভিল ভলান্টিয়ারদের। বিদেশ ফেরতদের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য গ্রাম পুলিশ, স্বাস্থ্যকর্মী, ইউপি সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার পাশাপাশি তাঁদের সচেতনও করছেন। তাঁরা যাতে ১৪ দিন পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বের না হন সেই বিষয়টি বলছেন বারবার। বিদেশ থেকে যারা দেশে ফিরেছে তাদের বাড়ীতে লাল পতাকা উত্তোলন করে দিয়েছে কয়রার প্রশাসন।
হাত-মুখ ধুয়ে ঢুকতে হবে অফিসে
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে কয়রা উপজেলা পরিষদ, থানা, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বন বিভাগের কয়রার কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন অফিসে প্রবেশের আগে হাত-মুখ ধোয়ার নিয়ম চালু করেছে কর্তৃপক্ষ। হাত ধোয়ার জন্য এসকল অফিসের প্রধান ফটকের সামনেই বসানো হয়েছে পানির কল। সেখানে রাখা হয়েছে সাবান। কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ বাহরাম জানান, করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে ওই সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অফিসের সামনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান, টিস্যুসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী রাখা হয়েছে। যারা আসছেন, তারা হাত ধুয়ে অফিসে ঢুকছেন।
করা হচ্ছে জীবাণুনাশক স্প্রে :
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কয়রায় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলি মসজিদ, মন্দির, জনসমাবেশ ঘটে এমন এলাকায় প্রতিনিয়ত জীবাণুনাশক ছিটানোর কাজ করে যাচ্ছেন। কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামের একটি সেচ্ছাসেবি সংগঠনের সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, করোনা আতঙ্কে কয়রা উপজেলা প্রায় অবরুদ্ধ। করোনা মোকাবেলায় ঘরে অবস্থান করার কোন বিকল্প নেই। তবে তারা চেষ্টা করছেন প্রতি দুই দিন পরপর জীবাণুনাশক স্প্রে করার। উপকূলের আইসিডি নামের একটি সামাজিক সংগঠনের সভাপতি মো. আশিকুজ্জামান বলেন, কয়রায় প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠন সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, সাবান বিতরণসহ জীবাণুনাশক স্প্রে করছে। এখনই সময়, সবাই যার যার জায়গা থেকে নিজে সচেতন হতে হবে এবং অন্যকে সচেতন করতে হবে। কে জানে হয়তো এই ছোট উদ্যোগগুলোর কারনে বেঁচে যেতে পারে অসংখ্য প্রাণ।
কয়রার আড়াইহাজার হতদরিদ্র পাবে খাদ্যসামগ্রী
করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়েপড়া উপকূলীয় উপজেলা কয়রার হতদরিদ্র অসহায় দুই হাজার আটশত পরিবারে জন্য খাদ্যসামগ্রী বিতরণের প্রস্তুতি সম্পর্ণ করেছে উপজেলা প্রশাসন। খুলনা জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা পরিষদের সমন্বিত প্রয়াসে কয়রার ৭ টি ইনিউনিয়নেই চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হবে এই খাদ্যসামগ্রী।
প্রথম ধাপে (২৮ মার্চ) শনিবার বেলা ১২ টার দিকে উপজেলার তিনশত পরিবারের মধ্যে দেয়া হয়েছে খাদ্যসামগ্রী। এতে প্রতি পরিবার পেয়েছে ১০ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, ২ কেজি আলু, ১ কেজি পেয়াজ ও ১ কেজি লবণ। এছাড়া একটি করে সাবান ও সুরক্ষা মাক্সও দেয়া হয়েছে । উপজেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তীতে ধাপেধাপে আরও আড়াইহাজার হতদরিদ্র পরিবারে পৌছে দেয়া হবে খাদ্যসামগ্রী।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল কুমার সাহা জানান, এই আপদকালীন সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষেরা যাতে অভাবে না থাকে সেই লক্ষ্যে কয়রার ৭টি ইউনিয়নের দুই হাজার আটশ পরিবারের কাছে আমরা খাবার পৌছে দেব। পরবর্তিতে এই কার্যক্রমের পরিধি আরো বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
করোনার পরিস্থিতি পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত সামর্থ্যানুযায়ী এই কর্মসূচি চালিয়ে যেতে কয়রা উপজেলার বিত্তবানদেরকেও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।