নিজস্ব প্রতিবেদক : ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরত্বের কাছে কোনঠাসা পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী। নিশ্চিত পরাজয় জেনে চরম ধ্বংসলিলায় মেতে উঠেছে পশুর দল। বিমান থেকে বিভিন্নস্থানে চালাচ্ছে একের পর এক বোমা হামলা। এ দিন দুপুরে খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়নের বরণপাড়া গ্রামে ঘটে যায় ভয়াবহ নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। শ্মশাণে পরিণত হয় ওই এলাকার খোশদেল মল্লিক ও আনসার মোল্যার বাড়ি। তখন টানা দুপুর। উঠোনের এক কোনে ৩ মাসের শিশু সন্তান রাজ্জাককে কোলে নিয়ে ধান সিদ্ধ করছেন খোশদেল মল্লিকের ১৬ বছর বয়সের স্ত্রী জরিনা বেগম। ঘরের বারান্দায় ভাত খাচ্ছেন খোশদেল মল্লিকের বৃদ্ধ পিতা সাজেম মল্লিক, খোশদেল মল্লিকের ভাই, ভাইয়ের স্ত্রীসহ সে নিজেও তখন বাড়িতে। কেউ পুকুর থেকে গোসল সেরে ঘরে ফিরেছে। কেউ উঠোনে কাজ করছে। হঠাৎ বিকট শব্দ। একটা দু’টো নয়। পরপর কয়েকটি বোমার শব্দ। চারিদিকে ধোয়ার কু-লি, মানুষের আর্তনাদ। এসময় জরিনা বেগম শিশু পুত্র বুকে থাকা অবস্তাতেই মাটির নিচে চলে যান। প্রায় ২ ঘন্টা পর সম্বিত ফিরে পাওয়ার পর সে একটি গর্তের মাঝে নিজেকে আবিস্কার করেন, তখন তিনি দেখেন শিশু আব্দুর রাজ্জাক বুকের সাথে লেপ্টে আছে। কোন মতে হামাগুড়ি দিয়ে গর্ত থেকে বের হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে যান তিনি। হয়ে যান বাকরূদ্ধ। ভয়, আতঙ্ক আর উদ্বেগে হাত পা অবশ হয়ে আসে। গোটা বাড়ি যেন একটি ধ্বংসস্তুপ; মৃত্যুপুরী। শ্মশানের মতো ভয়ঙ্কর, বিভৎস্য। চারিদিকে বারুদের গন্ধ, ঘরের অস্থিত্ব বিলীন হয়েছে। আর বিপরীত পাশের ঘরটির একপাশ তছনছ হয়ে পড়ে আছে। যেখানে সেখানে রক্ত, মাংসপি-, ঝলসানো শরীর, হাড়গোড় আলাদা হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। একমাত্র শিশু সন্তান রাজ্জাক মল্লিক আর জরিনা ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। কোথায় কার লাশ তাও চেনার উপায় নেই। প্রাণপ্রিয় স্বামী খোশদেল মল্লিক, শ্বশুর সাজেম মল্লিক, কলিজ্বার টুকরো ছেলে শাজাহান মল্লিক, দেবর নজির মল্লিক, তার স্ত্রী আবেদা বেগম, ও তাদের ফুটফুটে কন্যা নূরজাহান মল্লিক কোথায় কে? কেবলই রক্ত, ঝলসানো মাংসপিন্ডু আর হাড়গোড়। একই পরিবারের ৬ জনের ক্ষত-বিক্ষত লাশের স্তুপ। বাকরূদ্ধ জরিনা বেগম সেদিনের সেই বিভৎস্য লোমহর্ষক মুহুর্তটি কিভাবে পার করেছিলেন তা আজও বলতে পারেন না। সেদিন কোথায় পেয়েছিলেন বেঁচে থাকার শক্তি জানেন না তিনি। সেই ভয়ংকর শ্মশাণের ভিতর ৩ মাসের শিশু রাজ্জাককে বুকে জড়িয়ে ভয়-বিহ্বলতার মাঝে বেঁচে থাকার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন আজকের বৃদ্ধা জননী জরিনা বেগম। সেই বিভৎস্যতা কোন দিন তাকে আর শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি। অসংখ্য রাত নির্ঘুম কাঁটিয়েছেন। অগণিত রাতে ঘুমের ঘরে স্বপ্ন দেখে ভয়ে মুষঢ়ে পড়েছেন। সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের কাছে সেই ভয়াবহ স্মৃতির বর্ণনা এভাবেই করছিলেন জরিনা বেগম। কথার ফাঁকে কয়েকবার শিশুর মতো কেঁদে ওঠেন তিনি। বারবার আঁচলে চোখ মোছেন। কখনও কান্না লুকাতে দমবন্ধ বসে থাকেন কিছুক্ষন। টানা ৪৯টি বছর স্মৃতির ক্ষত বুকে নিয়ে এভাবেই কেঁদে চলেছেন সব হারানো জননী। তবুও আজও এ পরিবারটি শহিদ পরিবারের স্বীকৃতি পায়নি। সেই দুঃসহ দিনগুলোতেও পায়নি কোন সহযোগিতা, পায়নি সান্তনা। যদিও পরবর্তীতে ওই দুই পরিবারকে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সুপারিশ করেছেন খুলনা-৫ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ, ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বি এম এ সালাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান, ফুলতলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজী জাফর উদ্দিন। প্রত্যয়ন পত্র দিয়েছেন ফুলতলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন। তবুও মেলেনি স্বীকৃতি। তবে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে জাতীর পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রিশ লাখ শহীদকে চিহ্নিত করার বক্তব্যে আশার ঝিলিক দেখা দিয়েছে তার চোখে। যদিও এখন কথায় কথায় কেবলই মৃত্যু কামনা করেন জরিনা বেগম। তার মৃত্যু কামনার সেই বেদণার্ত আক্ষেপ মনে করিয়ে দেয় কবি জসিম উদ্দিনের সেই অনবদ্য উক্তি, ‘মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কতদূর।’ এদিকে সেদিনের ৩ মাসের সেই ছোট্ট শিশু রাজ্জাককে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করেছেন সবহারানো অসহায় জননী জরিনা বেগম। রাজ্জাক বুঝতে শিখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উজ্জিবীত হন। বর্তমানে আব্দুর রাজ্জাকের বয়স ৪৯ বছর। তিনি ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। রাজ্জাকের একটিই চাওয়া ‘ভাতা নয়, কেবল শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি চাই’। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।