ইউনিক প্রতিবেদক:
খুলনা জেলার নিরালা সরকারি কবরস্থানের এক অংশ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারণ করে আলাদা সীমানা দিয়ে ঘিরে দেয় খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি)।
২০১৩ সালের ৮ই মে মহানগরীর ২৪নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত কবরস্থানটির ফলক উন্মোচন করেন কেসিসি’র মেয়র আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক। স্বাধীনতার পর মৃত্যুবরণ করা ৩২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দাফন করা হয়েছে নিরালা বীর মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে।
মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সেরা সন্তান। তাদের জন্য স্বাধীন দেশ পেয়েছি, তাদের জন্য স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারি। মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ কোনদিন শোধ কোনো ভাবে শোধ করার মতো নয়। তারপরও মুক্তিযোদ্ধার কবরগুলোর প্রতি অভিযোগ উঠেছে অযত্ন-অবহেলার।
নিরালা বীর মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানটির স্থায়ী সীমানা প্রাচীর পাকা করে দেওয়া হলেও ২০২০ সালে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দূর্যোগ আম্ফান ঝড়ে গাছ পড়ে ভেঙে যায় সীমানা প্রাচীর। অবহেলার কারণে যা আজও সংস্কার করা হয়নি। অবাধে বিচরণ করছে গবাদি পশু। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কবরস্থান পরিণত হয়েছে জঙ্গলে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নেই কোনো পৃথক রেজিস্ট্রি বই অথবা স্থায়ী নাম ফলক। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেওয়া সেই শহীদের স্মৃতির শেষ চিহ্নটুকুও। অগোচরেই রয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের কাছে শহীদদের ইতিহাস।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক বলেন, ‘বয়স অনেক হয়েছে। এখন শুধুমাত্র শেষ ইচ্ছা হিসেবে আমার পরিবার ও সিটি মেয়রের কাছে একটাই অনুরোধ মৃত্যুর পর আমাকে নিরালা বীর মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে দাফন করা হয়। কিন্তু কবরস্থানের মন্দা অবস্থা দেখে বড় কষ্ট পেলাম। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, যাদের জন্য স্বাধীন দেশ পেয়েছি তাদের কবরগুলো এমন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। কেউ ঠিক মত রক্ষণাবেক্ষণও করছেনা। ভাবতে খারাপ লাগে যে আমার কবরও কী তাহলে এমন অবহেলায় পরে থাকবে।’
নিরালা কবরস্থান জামে মসজিদের ঈমাম মুফতি ওলি উল্লাহ মাহমুদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন হল কবরস্থানের দেয়ালটি ভেঙে পরে আছে। এখনও সংস্কার হচ্ছেনা। আমি মসজিদ ও মাদ্রাসা কমিটির সদস্য। আমার বর আমাদের কবরস্থানের কোনো বষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। কবরস্থান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রেজিস্ট্রি ম্যান ও সিটি কর্পোরেশনের।’
কবরস্থানের দায়িত্বরত রেজিস্ট্রি ম্যান মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আম্ফান ঝড়ে গাছ পড়ে কবরস্থানের প্রাচীর ভেঙে গেছে। এ বিষয়ে আমি সিটি কর্পোরেশনকে লিখিতভাবে অবগত করেছি।’
তার কাছে কবরস্থানের পরিষ্কার-পরিছন্নতা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কবরস্থান সংস্কারের সময়ই সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা হবে। তবে এর মধ্যে কেউ ব্যক্তিগত ভাবে পরিষ্কার করতে চাইলে করতে পারবে।’
নিরালা কবরস্থানে গবাদি পশুর বিচরণ নিয়ে অভিযোগ তুললে কবরস্থানের দাড়োয়ান কাজি লিটন জানান, ‘কবরস্থানের পূর্ব পাশের গেট ভাঙা থাকায় সুযোগে এলাকার মানুষ তাদের গবাদি পশু ঘাস খাওয়াতে নিয়ে আসে। এ বিষয়ে পশু মালিকদের ধর্ম, ভালো-মন্দ, ভয় সকল ভবে বোঝানো হলেও কোনো কাজ হয়না। এ বিষয়ে তাদের সাথে ঝগড়া বিরোধ, পশু আটকে রাখা সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘যত দ্রুত পূর্ব পাশের গেট সংস্কার করা সম্ভব হবে, ততো দ্রুত এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খুলনা মহানগরীর নিরালা দিঘির পাড় এলাকায় অবস্থিত কবরস্থানটির ভেতরে এক অংশ ২০১৩ সালে কেসিসি’র মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারণ করে ভিত্তি ফলক উন্মোচন করে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেয় যা আজ মাটিতে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে। এদিকে কবরস্থানের পূর্ব পাশের গেট দীর্ঘদিন নষ্ট থাকায় সাধারণ মানুষের চলাচলের রাস্তায় পরিণত হয়েছে। প্রাচীর ভাঙা থাকাই অবাধে গবাদি পশুর বিচরণ লক্ষ্য করা গেছে। রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ঝোপ-জঙ্গলে ভরে গেছে কবরস্থান ও আশপাশের এলাকা।
কবরস্থানের ভেতরে চলাচলের জন্য রাস্তা দুর্গম হওয়ায় অনেক পরিবার তার প্রিয় জনের কবরের কাছে যেতে পারছে না।
নিরালা বীর মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে বর্তমানে মকবুল হোসেন মোল্লা (বকু), মোঃ নওয়াব আলী চৌধুরী, আলহাজ¦ আব্দুল জব্বার শেখ, মোঃ হাবিবুর রহমান, মোঃ আবু জাফর শেখ, মোঃ আমির খসরু, মোঃ শাহ্জাহান ফকির, নৌ কমান্ডো মোঃ মুজিবর রহমান, মোঃ আকিকুর রহমান, গাজী সাঈদ আলী, শেখ একরাম আলী, মোঃ সেকেন্দার আলী, কাজী দীন মোহাম্মদ, সোহেল আহমেদ, শেখ সিরাজুল হক, ৯নং সেক্টরের এম এ হাশেম, মোঃ আবুল কামাল, ডাঃ এস এম মনিরুল ইসলাম (টিপু ডাক্তার), উইং কমান্ডার সৈয়দ নুরুল হুদা, এফ এম মোসলেম উদ্দীন, হাজী রহমত আলী মোল্লা, মোঃ মোদাচ্ছের আলী, মোঃ এমদাদুল হক তরফদার, আলহাজ¦ এস এম নজিবুল ইসলাম, নূরুল আমিন মুন্সি, আলহাজ¦ আব্দুল জলিল শিকদার, খিজির আলী বীর বিক্রমসহ আরো পাঁচ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এই কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।