আইলার ১০ বছর : কয়রার জনপদজুড়ে শুধুই আক্ষেপের গল্প

প্রকাশঃ ২০১৯-০৫-২৪ - ১২:৪৪

ইমতিয়াজ উদ্দিন, কয়রা : আর একদিন পরেই ২৫ মে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার ১০ বছর। দীর্ঘ ১০টি বছর পরও কয়রার মানুষের মন থেকে মূছে যায়নি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্নিঝড় আইলার ক্ষতচিহ্ন । ১০টি বছর কয়রা উপজেলার জনপদ জুড়ে আক্ষেপের গল্পগুলিই শুধু দীর্ঘ হয়েছে।সেই দুর্যোগে সর্বস্ব হারানো অনেকেই এখনো খুজে ফিরছেন স্থায়ী নিবাস। আবার অনেকেই আবাস হিসেবে বেছে নিয়েছে বেড়িবাঁধের কিনারাকে। সেটির অবস্থাও এখন নাজুক। ঠিক হয়নি বিশুদ্ধ পানির উৎস, মাইলের পর মাইল ছুটতে হয় সুপেয় পানির জন্য।
উপজেলার পাথরখালী এলাকায় বেড়িবাঁধের ওপর এখনো দূর্বিষহ জীবন পার করছে আইলায় গৃহহারা ২২টি পরিবার। কয়রা সদরের গোবরা সোনাপাড়াসহ ৫০টি পরিবার বাঁধের ওপর। সুতির অফিস এলাকা থেকে মঠবাড়িয়া বেড়িবাঁধের উপর সারি সারি বাস্তুহারা মানুষের বসবাস চোখ এড়ায়না। এছাড়া ৪নং কয়রা লঞ্চ ঘাট এলাকা, ৬নং কয়রা, দক্ষিণ বেদকাশী ও মহেশ্বরিপুরসহ গোটা উপজেলা জুড়ে বাধের উপর বসবাসরত দুই শতাধিক পরিবারের আক্ষেপেভরা কথাগুলি কষ্টের বিলাপ হয়ে বড্ড কানে বাজে।
২০০৯ সালের ২৫ মে সুন্দরবনের কোলে গড়ে ওঠা এ জনপদ সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। সেদিন পাউবোর বেড়িবাঁধের ২৭ টি পয়েন্ট জলোচ্ছাসে ভেঙে গেলে তাৎক্ষনিক গোটা উপজেলা লোনা পানিতে তলিয়ে যায়। কেঁড়ে নেয় ২৬ ব্যক্তির প্রাণ। স্বজন হারানো সেই দু:সহ স্মৃতি নিয়ে পুনরায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লবন পানি প্লাবনের আতংকে সংকিত কয়রাবাসী। আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধগুলো কোনো মতে মেরামত করা হলেও এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রথমবার বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর আর কখনোই শক্ত করে বাঁধ তৈরি হয়নি। ফলে বার বার ভাঙছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে কয়রার ২৫ কিলোমিটাররে মত বেড়িবাঁধ জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে। বেড়িবাঁধের কোথাও কোথাও মাত্র দেড় থেকে দুই হাত মাটি অবশিষ্ট রয়েছে। অবস্থা এতটাই খারাপ যে, বাঁধের অনেক জায়গা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে (লিকেজ) পানি প্রবেশ করছে।
তবে এত কিছুর পরেও এখনো এই জনপদে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মিত হয়নি। সেই জোড়াতালির বেড়িবাঁধ, দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত কার্যক্রমের অভাব এখনো দৃশ্যমান। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। দাতা সংস্থানির্ভর এনজিও কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বহুদিনের পুরোনো বেড়িবাঁধগুলোর টেকসই সংস্কার ও বাঁধ উন্নয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দীর্ঘসূত্র ও তৎসংশ্লিষ্ট দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও চিংড়িচাষিরা বাঁধগুলো ছিদ্র করে তাঁদের ঘেরে লবন পানি তুললেও কোন এক অদৃশ্য কারণে নির্বাক প্রশাসন। সরেজমিনে দেখা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় মাটি দেওয়ার উদ্যোগ না নেওয়ায় ঝুঁকির মুখে রয়েছে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা, খাসিটানা, জোড়শিং, মাটিয়াভাঙ্গা। উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরি, গাববুনিয়া, গাজিপাড়া, কাটকাটা। কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬নং কয়রা, ৪নং কয়রার পুরাতন লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, মদিনাবাদ লঞ্চ ঘাট, ঘাটাখালি, হরিণখোলা। মহারাজপুর ইউনিয়নের উত্তর মঠবাড়ি, দশালিয়া, লোকা। মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কালিবাড়ি, নয়ানি, শেখেরটেক এলাকা। এ সকল বাঁধ দ্রুত সংস্কার করা না হলে আবারো বাঁধ ভেঙে গোটা উপজেলা লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, কোনো এক সকালে যেন দেখতে না হয় কয়রা উপজেলা আবারও পানির নিচে। প্রলংকারী ঘুর্ণিঝড় আইলার কথা মনে পড়লে এখনও শরীর শিউরে ওঠে। তিনি জানান, কয়রা উপজেলার অনেক বেড়ি বাঁধ এখনও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। নাজুক বেড়িবাঁধের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে। আগামীতে পাউবো ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো মেরামত করবে বলে আশা করছেন তিনি।
খুলনা-৬ আসনের (কয়রা-পাইকগাছা) সাংসদ আখতারুজ্জামান বাবু বলেন, বিগত দিনে যথেষ্ট বরাদ্দ থাকলেও বেড়িবাঁধ বাধার দায়িত্ব যাদের ছিল, তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করেননি। তিনি আরও বলেন, আমি টেকসই ভেড়ি বাঁধের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থায়ী ভেড়ি বাঁধের কাজ শুরু হবে।