আজ ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস

প্রকাশঃ ২০২০-০৫-১৬ - ১৪:৫৭
আজ ১৬ মে  ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস। এই দিনে প্রায় ৪৪ বছর আগে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলায় উদ্দামী জনতাদের সাথে নিয়ে ফারাক্কাকেন্দ্রিক আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের সেই ঐতিহাসিক মিছিলের পরও আজ পর্যন্ত ফারাক্কার অভিশাপ বুকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে চাপা দীর্ঘশ্বাসই কেবল ফেলে যেতে হচ্ছে। প্রবাহহীন নদীতে পরিণত বাংলাদেশের পদ্মায় ফারাক্কার প্রভাবে পানি নেই। তাই খণ্ড খণ্ড অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে এর স্রোতধারা। ভারতের প্রনব মুখার্জী ও মমতা ব্যানার্জী বলেছিলো আমাদের উপর বিশ্বাস রাখুন আমরা রেখেছি, তাতে ফল হয়নি কিছুই।
আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার পানির অংশ শুধু ফারাক্কা নয় সকল নদীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নদীকে কেন্দ্র করে আলোচনা, বিতর্ক ও আন্দোলন হয়েছে অনেক।
মওলানা ভাসানীর লং মার্চ ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছিল বলেই সেদিন লাখো জনতার প্রতিবাদে দিল্লীর মসনদ কেঁপে উঠেছিল। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লং মার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়েছিল। পরদিন ১৭ই মে সকালে আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে। লক্ষাধিক মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন এই লং মার্চে। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।’ মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন ক্ষমতার মোহমুক্ত সাধারণ জীবন-যাপনকারী গণমানুষের নেতা। আসামের নবাব স্যার সা’দুল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়া, কাজী জাফর আহমেদ ছিলেন মওলানা ভাসানীর সেক্রেটারি। অথচ তিনি বাস করতেন সাধারণ ছনের ঘরে। ১৯৭৪ সালে ডিসেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টাঙ্গাইলের সন্তোষে যান তার রাজনৈতিক গুরু মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করতে। তিনি লক্ষ্য করলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু তখনও বাস করেন ছনের ঘরে- হোগলার বেরা দেয়া ঘরে। বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতার নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে বললে মওলানা ভাসানী তাকে বলেন, ‘‘আমার নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি তোমার নিরাপত্তা মজবুত কর। আমার নিরাপত্তা দেবেন আল্লাহ এবং সাধারণ জনগণ।’’
এদিকে ভারত গঙ্গার উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলী ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেয়া শুরু করে। এখানেই শেষ নয়, ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার ওপর আর একটি বাঁধ নির্মাণ করে। এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশত পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেয়। এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হয়। ফলে বাংলাদেশের হাজারো চিৎকার আর আহাজারি স্বত্ত্বেও ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না থাকার ফলে বাংলাদেশ তার ‘ন্যায্য হিস্যা’ দূরে থাক, সাধারণ চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারছে না। ভারত তার বহু সংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে পারছে মাত্র ১০ ভাগ।
ফারাক্কার প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গঙ্গা-পদ্মা ছাড়াও অন্যান্য ছোট ও মাঝারি ধরনের নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা এখন অনেকটাই মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় অতি আসন্ন। ভারত বলে আসছে যে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয়- নদীকেন্দ্রিক এমন কোন প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করবে না। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত।
গঙ্গায় দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা’ প্রকল্পের রিপোর্টেও বলা হয়েছে, মারাত্মক ক্ষতিকারক কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া মিশছে গঙ্গায়। গঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে।
নদী দূষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এই নদীতে এখন পানিপ্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণ। পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের মতে, গঙ্গা কানপুরে পৌঁছার আগেই ৯০ শতাংশেরও বেশি পানি কৃষি জমিতে সেচের জন্য অপসারণ করে নেয়া হয়। ফলে যে সমস্যাটি হয় তা হচ্ছে আরো নিম্নাঞ্চলে দূষণ বা অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া নদীর উজানে পানিবিদ্যুত প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ করে এই স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করা হচ্ছে। আড়াই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করে এবং পিলার দিয়ে সেতু নির্মাণের ফলে স্বাভাবিক প্রবাহও দিন দিন অবরূদ্ধ হয়ে পড়ছে।  এমতাবস্থায় পরিবেশকর্মীরা অনেকেই মনে করেন, পরিস্থিতির পরিবর্তনে গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার কোন বিকল্প নেই।
 ভারতে গঙ্গায় ফারাক্কা, বরাকে টিপাইমুখ, তিস্তায় অসংখ্য বাঁধ, রঙ্গিতের উপর বাঁধ, সুবানসিরির বাঁধ প্রভৃতি নিয়ে জনসাধারণের ক্ষোভ এবং কাবেরী ও মহানদীর পানি নিয়ে আন্তঃরাজ্য বিরোধের মতো বিষয়গুলো সেখানকার দীর্ঘদিনের বহুল আলোচিত সমস্যা। এই আন্তঃরাজ্য ও রাজ্যকেন্দ্রিক ক্ষোভ নিয়ে প্রতিনিয়ত বিতর্ক চলছে। স্বচ্ছতা ও তথ্যের অভাবে রাজ্যগুলো পরস্পরের বিপক্ষে উপনীত হয়।
নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-এর সভাপতি এডভোকেট এনামুল হক বলেন, এ অবস্থায় বাংলাদেশের জনগণের দাবি হলো, সর্বপ্রথম ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তাদের আগ্রাসী নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। গঙ্গার পানি বণ্টনের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীর বিষয়ও আলোচনাভুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ জাতিসংঘের মাধ্যমে বিষয়টির সমতাভিত্তিক নিষ্পত্তির জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে।
মোঃ আব্বাস আলী
সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
জি,টি ডিগ্রী কলেজ, কোটচাঁদপুর
ঝিনাইদহ।