আম্ফানের ৯ মাস পরেও কমছেনা ভূক্তভোগীদের দূরাবস্থা

প্রকাশঃ ২০২১-০২-২৬ - ১৯:৫০

কয়রা : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলা খুলনার কয়রা ও পাইকগাছার প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা এবং উপকূলীয় বাঁধ সুরক্ষা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারনে এ সমস্যা আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। দীর্ঘ দিন যাবৎ জলাবদ্ধতা এবং উপকূলীয় বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়া বা উপচিয়ে এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঘটনা এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দুটি সমস্যার তীব্রতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার প্রায় ৪৫ লক্ষ অধিবাসী এ সমস্যা দুটি দ্বারা আজ দিশেহারা ও সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে। অত্র এলাকায় ব্যাপকভাবে ঘটে চলেছে বা¯’চ্যুতির ঘটনা। এলাকার মানুষদের কাছে এখন প্রধান প্রশ্ন আদৌ এ এলাকায় বসবাস করা যাবে কিনা এবং কিভাবে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করবে? বলা বাহুল্য এ সমস্যা দ্বারা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ এবং জর্জরিত জনগোষ্ঠী হলো দরিদ্র ও দুস্থ শ্রেণি এবং নীচু এলাকায় বসবাসরত অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষরা। এদের মধ্যে বিশেষ করে দরিদ্র মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধী মানুষদের ভোগান্তি এবং আহাজারীর কথা বলে শেষ করা যাবে না। ২০০৪ সাল থেকে সুনামি, সিডর, বিজলী, রেশমী, আইলা, নার্গিস, মহাসেন, বুলবুল, আম্ফান প্রভৃতি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মূর্তিমান ভয়াল রূপ দেখে এলাকার মানুষ আতংকিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারনে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার সময় জোয়ারের উচ্চতা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে অনেক এলাকা বাঁধ ভেঙ্গে বা উপচিয়ে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বর্ষাকালে দেখা যায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা স্বাভাবিকের তুলনায় ১ মিটার উচ্চ থাকে। এ সময় বিশাল উজান অঞ্চলের পানির চাপ ও বাতাসের তোড়ে নদীতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, উচ্চতার আঘাতে নদী তীরে দেখা দেয় ভাঙ্গন। ২০২০ সালের ২০ মে উপকূলের জনপদে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আম্ফান প্রবল বেগে আঘাত হানে। বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে বাঁধ ভেংগে এলাকা প্লাবিত হয়। এর একমাস পর আর একটি অতি উচ্চ জোয়ারের চাপে পরিস্থতির আরো অবনতি ঘটে। পরিস্থতি সরেজমিনে দেখা এবং প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের জন্য এলাকার নাগরিক সমাজের সংগঠন পানি কমিটির সহায়তায় একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করা হয়। রিপোর্টে দেখা যায় খুলনা জেলার কয়রা ও পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনী উপজেলার মোট ১৪টি ইউনিয়নের ২০টি জায়গায় উপকূূলীয় বাঁধ ভেংগে এলাকা প্লাবিত হয়েছে এবং ৪২টি পয়েন্টে আনুমানিক ৯৫ কিমি বাঁধ অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, যে কোন সময় এ বাঁধগুলো ভেঙ্গে যেতে পারে। ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধগুলোর আওতাভ্ক্তূ ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সংখ্যা হবে প্রায় ৪৪ হাজার পরিবার। এর মধ্যে কয়রা ও পাইকগাছায় প্রায় ১১ হাজার ৫ শত পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহের দূর্দশা লাগবের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে জরুরী খাদ্য, নগদ অর্থ, হাইজিন কিট, প্রয়োজনীয় ঔষধ সামগ্রী, গৃহায়নে সহায়তা করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। বর্তমানে কারিতাস বাংলাদেশ-খুলনা অঞ্চলের উদ্যোগে স্টার্ট ফান্ড ও ইউকেএইডের অর্থায়নে কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে তিনমাস ব্যাপী মানবীয় সহায়তাদান প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা হচ্ছে ১ হাজার ৯ শত পরিবার। এর মধ্যে ৭ শত ৫০ টি পরিবারের মাঝে জনপ্রতি নগদ ৯ হাজার টাকা ও ১ হাজার ১৫০টি পরিবারের ৩০দিন কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে ১১টি বাঁধ কাম রাস্তা মেরামত, দুটি সেল্টার উঁচুকরণ ও একটি পুকুর পাড় উঁচুকরনের বিনিময়ে জনপ্রতি ৯ হাজার টাকা নিশ্চিত করা; ক্ষতিগ্রস্ত ২ শত পরিবারে বেড়াসহ স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন প্রদান। মিঠা পানি নিশ্চিত করার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ১১ টি পিএসএফ মেরামতকরণ। ১ হাজার ৯ শত পরিবারে স্বাস্থ্যবিধি চর্চার জন্য উপকরণ ও কোভিড-১৯ বিষয়ে সচেতনতামূলক উঠান বৈঠকের আয়োজন করা হয়। কার্যক্রমগুলো দৃশ্যমান ও প্রশংসার দাবি রাখলেও ৮ মার্চ ২০২১ তারিখে শেষ হতে যাচ্ছে প্রকল্পটি। যে সকল পরিবারগুলো এখনো সহায়তার আওতায় আসেনি এবং যে সকল বাঁধগুলো মেরামত হয়নি সেগুলোর বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। বানভাসি মানুষের কথা চিন্তা করে দীর্ঘ মেয়াদি কর্মসূচি গ্রহণ করা যেমন, উপকূলীয় বাঁধ উঁচু ও মজবুত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ, নদ-নদীর নাব্যতা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, জনগণ, স্থানীয় পরিষদ ও বেসরকারী সংগঠনকে যুক্ত করে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষন কমিটি গঠন করা, দুর্যোগ মোকাবেলা সংক্রান্ত সরকারী কমিটিগুলো সক্রিয়করণ করা, দুর্যোগপ্রবন এলাকা বিবেচনা করে বছরের জলাবদ্ধতার সময়টিতে ভূক্তভোগী জনগণের জন্য সুষম খাদ্য-সামগ্রী সরবরাহ করা।