ইবিতে শিক্ষার্থী সংকটের কারণ গুচ্ছ নাকি সমন্বয়হীনতা?

প্রকাশঃ ২০২৩-০২-১৭ - ১৭:০৫

কুষ্টিয়া : চলতি মাসের ৮ তারিখ প্রকাশিত হয়েছে এইচএসি পরীক্ষার ফলাফল। ফল প্রকাশের পরই আগামী ১০ মার্চ থেকে ২০২২-২৩ মেডিকেল শিক্ষাবর্ষের ভর্তির তারিখ ঘোষণা হয়েছে। আগামী ২০ মে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ২৯-৩১ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) এবং আগামী ২৯ এপ্রিল থেকে ১৩ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) স্নাতকে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়েছে। খুব বেশি দেরি না হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও (চবি) কিছুদিনের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করবে। বুয়েট, মেডিকেল বাদে প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে এ চার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরপরই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) অবস্থান। প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার নানা সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একেবারেই কম না। তারপরও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তির কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি ইবি। প্রতিষ্ঠানে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়েছে ছয় মাস হতে চললো। এ সময়ের মধ্যে ঢাবি, রাবি, জাবি ও চবিতে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এক সেমিস্টার শেষ হচ্ছে। অথচ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযজ্ঞ এখনও শেষ হয়নি। এ ব্যর্থতার পেছনের কারণ, এক থেকে বারো পর্যন্ত মেধাতালিকা দিয়েও আসন পূর্ণ করতে না পারা। এমনকি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক শিক্ষার্থী খুঁজে পাচ্ছে না ইবি। আসন পূরণ না করেই গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী পেতে ইবিকে কেন এত বেগ পোহাতে হচ্ছে, এটি বড় প্রশ্ন। শিক্ষার্থীরাই বা কেন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, সে প্রশ্নও জন্মেছে জনমনে। ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি না করতে পারার পেছনে ইবির গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বলছে, গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত ভর্তির জন্য একেকটা ধাপ সম্পন্ন করতে গিয়ে আসন পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। জানা গেছে, জিএসটিভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার মধ্যে ‘এ’ ইউনিটের গত ৩০ জুন, ‘বি’ ইউনিটের ১৩ আগস্ট ও ‘সি’ ইউনিটের ২০ আগস্ট পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ৪ আগস্ট ‘এ’ ইউনিট, ১৬ আগস্ট ‘বি’ ইউনিট ও ২৩ আগস্ট ‘সি’ ইউনিটের ফলাফল প্রকাশ করে জিএসটি কর্তৃপক্ষ। ফলাফল প্রকাশের প্রায় দুইমাস পর ২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন। চলে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত। গুচ্ছ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে মোট ৪২ হাজার ৪২৯ জন শিক্ষার্থী ইবিতে আবেদন করে। পরবর্তীতে গত ৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথম মেধাতালিকা প্রকাশ করে ও ৭ থেকে ১২ নভেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক ভর্তি শেষ করতে নির্দেশ দেয় প্রশাসন। প্রথম মেধাতালিকা থেকে ১৯৯০টি আসনের মধ্যে থেকে মাত্র ৫৫৩টি আসনে শিক্ষার্থী প্রাথমিক ভর্তি হয়। এরপর থেকে একের পর এক মেধাতালিকা প্রকাশ করে যাচ্ছে প্রশাসন। কিন্তু পূরণ হচ্ছে না নির্দিষ্ট আসন। দশ মেধাতালিকায় থেকে যারা প্রাথমিক ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করেছেন, তাদের চূড়ান্ত ভর্তি চলে চলতি বছর ২৯ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। চূড়ান্ত ভর্তি শেষে আসন খালি থাকে ৪৮১টি। তারপর গত ১০ ফেব্রুয়ারি ১১তম ভর্তি তালিকা প্রকাশ করে ইবি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতেও পূরণ হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট আসন। পরে বাধ্য হয়ে গত সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দ্বাদশ মেধাতালিকায় ভর্তির জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। সেটি থেকেও নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। আসন ফাঁকা থাকে ৭৪টি। এসব আসন পূরণে গতকাল বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ত্রয়োদশ তালিকা প্রকাশ করেছে প্রশাসন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুচ্ছভুক্ত প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির চিত্রই ছিল প্রায় একই। নির্দিষ্ট আসন পূরণের লক্ষ্যে একের পর এক তালিকা প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ভর্তির দীর্ঘসূত্রিতাও ছিল এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যদিও এর মধ্যে নির্দিষ্ট আসনে শিক্ষার্থী পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এখনও কিছু আসন খালি আছে। গুচ্ছভুক্ত ২২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি), নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি), যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) নির্দিষ্ট আসনে তাদের ভর্তি শেষ করেছে। দুটি আসন ফাঁকা রেখে ভর্তি বন্ধ করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)। ইবির ৭৪ আসন এখনও ফাঁকা। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষেও একই পরিস্থিতি ছিল এ প্রতিষ্ঠানে। সে সময় ১০০ আসন ফাঁকা রেখেই ভর্তি বন্ধ করতে হয় প্রশাসনকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইবির সুযোগ-সুবিধা অনেকাংশেই বেশি। গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে পুরনো। প্রতিষ্ঠানে যুগোপযোগী বিভাগ, গবেষণার সুযোগ, আবাসন ব্যবস্থাসহ নানা দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও শিক্ষার্থীর অভাব, চলে আসছে কয়েকবছর ধরে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাসহ অন্যান্য কার্যক্রমেও ইবি বেশ সফল। এত কিছুর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার আগ্রহ কেন কম? দুই শিক্ষাবর্ষ আগেও এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা ভর্তির জন্য মুখিয়ে থাকতো, কিন্তু এখন একের পর এক বিজ্ঞপ্তি দিয়েও আসন পূর্ণ হচ্ছে না কেন? ও সংশ্লিষ্ট আরও কিছু প্রশ্ন করা হয় ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। সবাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে না চাইলেও নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন কয়েকজন। এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক এ ব্যাপারে বলেন, গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাধর্মী পড়াশোনা অনেক কমে গেছে। রাজনীতির মাঠে সময় দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা প্রয়োগ করতে পারছেন না অনেক শিক্ষক। যে কারণে সেশনজট বাড়ছে। শ্রেণিকক্ষ থেকে প্রশাসনিক পদটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কমে যাওয়ার পেছনে এ কারণটাই অধিকাংশে দায়ী। ভর্তির ক্ষেত্রে গুচ্ছ পদ্ধতিকেও দায়ী করেন কেউ কেউ। তাদের ভাষ্য, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আবেদন, মেধাতালিকা প্রকাশের পর প্রাথমিক ভর্তি; পছন্দক্রমে থাকা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইগ্রেশনের সুযোগ; প্রাথমিক ভর্তি শেষে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তনের সুযোগ ও চূড়ান্ত ভর্তি। দীর্ঘ এ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে শিক্ষার্থীর হার কম-বেশি হতে থাকে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে আসন পূরণ সম্ভব হয় না। তা ছাড়া প্রচুর সময় ব্যয় হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকরা ইবিতে ভর্তির ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া আসন পূরণ না হওয়ার জন্য জিএসটির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে ইবির সমন্বয়হীনতাও দায়ী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি, গুচ্ছ ভর্তির কারণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্রতা ও জৌলুশ হারিয়েছে। ইবি যতটা এগিয়ে গিয়েছিল, দুইবার গুচ্ছ পদ্ধতির কারণে আবার পিছিয়ে গেছে। গুচ্ছের অসংগতিই এবার শিক্ষার্থীর সংকট প্রকট আকার ঘটিয়েছে। বারবার মেধাতালিকা প্রকাশ ও গণবিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীদের মেধার মূল্যায়ন করা হয়নি। যারা ‘মোটামুটি’ নম্বর পেয়েছে তারাও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। দুবার ধাক্কা খেয়েও কর্তৃপক্ষের টনক না নড়া- বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আরও তলানিতে নিয়ে যাবে বলেও তারা মনে করেন। শিক্ষার্থী ভর্তি না হওয়া ও দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক ড. আহসান-উল-আম্বিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, গুচ্ছের কেন্দ্রীয় ও ইবি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতার কারণে বেশি কালক্ষেপণ হচ্ছে। ভর্তি প্রক্রিয়ার ব্যাপারে পূর্বে পরিকল্পনা না করে শেষের দিকে এসে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়। আবার বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় ভোগান্তি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। একই কারণ উল্লেখ করেছেন ইবির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোয়াদ্দারও। তিনি বলেন, প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার মূল কারণ সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতা। এখানে নির্দিষ্ট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে দোষী করা যায় না। গুচ্ছ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা সবাই এর জন্য দায়ী। গুচ্ছ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রথমবারেই অসন্তোষ জানিয়ে আসছিলেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারের উপর মহল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত থাকায় ২১-২২ শিক্ষাবর্ষে এক প্রকারের জোরপূর্বক মানতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকরা। এর মধ্যেই সামনের বছর থেকে গুচ্ছতে না থাকার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি। কেউ কেউ আবার বলছেন, গুচ্ছ প্রক্রিয়া নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে বিরূপ ধারনা জন্মেছে অনেক আগেই। যে কারণে অনেকেই এ প্রক্রিয়ায় ভর্তির কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করছেন না। ফলে নতুন শিক্ষাবর্ষে আসন পূরণ হচ্ছে না। সামগ্রিক বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুস সালাম বলেন, ভর্তির বিষয়টি আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় করতে হয়। মাইগ্রেশন বন্ধ হওয়া নিয়ে মাঝে হাইকোর্টে একটা কেস হয়েছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেও সময় লাগে। আর ভর্তির বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তও আমার একার না। আমরা সেন্ট্রাল টেকনিক্যাল কমিটির ওপর নির্ভর করি। সমন্বয়হীনতা তো বলা যায় না। এতে শিক্ষার্থীদেরও সুবিধা হয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়নি। আর আমাদের মুশকিল হলো- ফিন্যান্সিয়াল বিষয়ে গভর্নমেন্টের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমরা চাইলেই তো সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারি না। ভর্তির দীর্ঘসূত্রিতার ভেতরেও ইবি থেকে তুলনামূলক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আসন পূরণ করতে পেরেছে। ইবি কেন পিছিয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, আমরা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুইমাস পিছিয়ে গেছি। এটা আসলেও দেখার ব্যাপার। আশা করি আমরা এটা পুষিয়ে নিতে পারবো।