এম জসীম উদ্দিন : পাল্টে গেছে লেনদেন ব্যবস্থা। ক্যাশলেস দুনিয়ায় জায়গা দখল করে নিচ্ছে বাংলাদেশ। এখন দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ লেনদেনে করছে ক্যাশলেস মাধ্যমে। অ্যাপসভিত্তিক ক্যাশলেস লেনদেন কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোড ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এ লেনদেন চলছে । এ ক্ষেত্রে সেবা দিচ্ছে মোবাইল ফাইন্যানসিয়াল কোম্পানি ও ব্যাংক। ক্যাশলেস সোসাইটি নতুন কিছু নয়, বিনিময়ের অসংখ্য পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে মানব সমাজ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই এটি বিদ্যমান। আজকের প্রেক্ষাপটে ক্যাশলেস সোসাইটি বলতে, আমরা বিশেষভাবে সেই সমাজগুলিকে উল্লেখ করি যেখানে ব্যাংকনোট বা চেকের পরিবর্তে ডিজিটাল তথ্য (সাধারণত অর্থের ইলেকট্রনিক উপস্থাপনা) দিয়ে আর্থিক লেনদেন পরিচালিত হয়।
ক্যাশলেস এই লেনদেন আগের চেয়ে অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে। নগদ অর্থ বহন ও পরিশোধ ঝুঁকিপূর্ণ, চেক পরিশোধ সময়সাপেক্ষ ও জটিল। এই পদ্ধতিতে সেই ঝামেলা নেই। নেই কোনো ভাংতি ও খুচরা টাকার ঝামেলাও। থাকছে না ছেঁড়া-ফাটা বা জাল নোটের আশঙ্কা। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের জন্য ব্যাংক, ব্যাংকের বুথগুলোকে ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো বিনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়।
প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ১৩ নভেম্বর ২০২২ এ রাজধানীর একটি হোটেলে ইন্টারঅপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেশন প্লাটফরম (আইডিটিপি) ‘বিনিময়’ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, শতভাগ মানুষকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সেবার আওতায় নিয়ে আসার অংশ হিসেবে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে ক্যাশলেস সমাজ প্রতিষ্ঠা সরকারের লক্ষ্য, সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে অনেকটা এগিয়েছে দেশ। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘সর্বজনীন পরিশোধ সেবায় নিশ্চিত হবে স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্লোগানকে সামনে রেখে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ শিরোনামে ক্যাশলেস ক্যাম্পেইন শুরু করে। দশটি ব্যাংক, তিনটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী এবং তিনটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) এই ক্যাম্পেইনে অংশ নেয়। ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য ছিলো ঢাকা শহরে আন্তঃপরিচালনাযোগ্য কিউআর কোড পেমেন্ট সিস্টেম জনপ্রিয় করা এবং নিম্ন-আয়ের গোষ্ঠীর মালিকানাধীন সহ লক্ষাধিক ছোট ব্যবসাকে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থার আওতায় আনা। এর অংশ হিসেবে, তারা মতিঝিল এলাকায় প্রাথমিকভাবে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং রাস্তার বিক্রেতাকে কিউআর কোড পেমেন্ট সিস্টেমের সাথে পরিচিত করেছে, যার মধ্যে চা স্টল, মুদি দোকান এবং হোটেল মালিকদের পাশাপাশি মুচি, ফল বিক্রেতা এবং হকার রয়েছে। মতিঝিলে ক্যাম্পেইন শুরু হলেও এর লক্ষ্য পুরো দেশকে ক্যাশলেস করা। এটি ধীরে ধীরে ঢাকা শহর এবং তারপর সারাদেশে সম্প্রসারণ করার সিন্ধান্ত রয়েছে। এই সেবা নিতে বা পেতে শুধুমাত্র একটা ব্যাংকের অ্যাপ থাকলেই চলবে। এই উদ্যোগে যুক্ত ব্যাংকগুলো হলো মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক। এ ছাড়া এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ, এমক্যাশ, রকেট ও কার্ড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড, ভিসা ও অ্যামেক্স এ সেবায় যুক্ত হয়েছে। কিছু ব্যাংক এবং MFS প্রদানকারীরা অতীতে মালিকানাধীন কিউআর কোড সরবরাহ করেছিল কিন্তু কোনো সার্বজনীন কিউআর কোড ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাংলা কিউআর চালু করেছে, যার মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংকের গ্রাহকরা অর্থপ্রদানের সুযোগ পাবে । গত শতাব্দির নব্বই দশকে বিশ্বে কিউআর কোডের প্রচলন শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ বাংলা কিউআর স্ট্যান্ডার্ড ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলা কিউআর কোড দিয়ে নির্দিষ্ট যেকোনো ব্যাংকের অ্যাপ ব্যবহার করে কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করা যায়। ফলে ব্যাংকের গ্রাহকদের বিভিন্ন নেটওয়ার্কের একাধিক কিউআর কোড ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
কিউআর-এর পূর্ণরূপ কুইক রেসপন্স। এটি একটি কন্টাক্টলেস পেমেন্ট পদ্ধতি, যেখানে কিউআর কোডটি মোবাইল অ্যাপে স্ক্যান করে দ্রুত লেনদেন করা যায়। এর জন্য প্রথমে মোবাইলে ব্যাংক বা এমএফএস বা পিএসপির অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয়। অ্যাপে পিন টাইপ করে লগ ইন করে যে দোকান বা মার্চেন্ট থেকে কিনতে হবে সেখানে আউটলেট প্রদর্শিত কিউআর কোড স্ক্যান করতে হয়। এরপর পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধ করার জন্য টাকার পরিমাণ লিখলে একটি ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) আসে। সেই ওটিপি টাইপ করে লেনদেন সম্পন্ন করা যায়। লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার পর পেমেন্টের কনফার্মেশন ও ডিজিটাল রিসিট পাওয়া যায়। এখন এক ব্যাংকের কিউআর কোড থাকলে যে কোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করার সুযোগ রয়েছে। এতদিন একটি ব্যাংকের কিউআর কোডে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের গ্রাহক পেমেন্ট করতে পারত। এটা খুবই সহজ পদ্ধতি। প্রতি বছর কেবল টাকা ছাপতেই সরকারের ৫০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। তাছাড়া এই টাকার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ, লেনদেনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা এবং তার ফলে যে সম্ভাবনার অপচয় হয় সেটির মূল্য অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকা। এই পদ্ধতিতে ছাপা টাকা ব্যবহারের বদলে ‘ক্যাশলেস’ লেনদেন নিশ্চিত করতে পারলে প্রতি বছর অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত চার বছরে কার্ডের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এই বছরের জানুয়ারিতে 4কোটি 33লাখ 47 হাজার 155টি কার্ড ছিল, যা 2019 সালের একই মাসে ছিলো 2কোটির সামান্য বেশি । ই-কমার্স ব্যবসা এবং বিদেশি ভ্রমণের বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কার্ডের লেনদেন বেড়েছে, মহামারির মধ্যে এটি আরও গতি পেয়েছিলো। ডেবিট, ক্রেডিট এবং প্রিপেইড কার্ডের সংখ্যার পাশাপাশি কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, 2019 থেকে জানুয়ারি ২০২৩ এই সময়ের মধ্যে, ডেবিট কার্ডে 177 শতাংশ বেড়ে 36,765 কোটি টাকা, ক্রেডিট কার্ডে 125 শতাংশ বেড়ে 2,506 কোটি টাকা এবং প্রিপেইড কার্ডে 200 শতাংশ বেড়ে 330 কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
ক্যাশলেস ব্যবস্থা হলো নগদহীন বা শুন্য নগদ মাধ্যম যেখানে নগদ টাকার পরিবর্তে ইলেক্টনিকভাবে লেনদেন সম্পন্ন করা হয়। ক্যাশলেস লেনদেন স্মার্ট বাংলাদেশের পথ প্রশস্ত করছে। আগামী দিনে বাংলাদেশের সব ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন ক্যাশলেস হয়ে যাবে, নগদ অর্থে লেনদেন হবে না। এর মাধ্যমে নগদ অর্থের ওপর নির্ভরতা কমে আসবে। উন্নতির ধারাবাহিকতায় এমন পরিবেশের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
লেখক: তথ্য অফিসার পিআইডি