হ্যালোথেন এর পরিবর্তে দিচ্ছে কেরোসিন তেল!
কামরুল হোসেন মনি : খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে গাইনীতে ভর্তি এক অপারেশন রোগীর জন্য বাইরে ওষুধ ফার্মেসি থেকে আনা হ্যালোথেন (অজ্ঞান সংশ্লিষ্ট ওষুধ) এর পরিবর্তে কেরোসিন (জ্বালানি) তেল পাওয়া গেছে। অপারেশন করার আগে বিষয়টি ধরা পড়ায় অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন রোগীসহ চিকিৎসকরা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে খুমেক হাসপাতালে গাইনী ওয়ার্ড ইউনিট-৩ এর রোগী জুলিয়া আকতারকে অপারেশনের হ্যালোথেন ব্যবহার করতে গিয়ে বিষয়টি ধরা পড়ে। খুমেক হাসপাতাল শাখার স্থানীয় কমিটির বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির (বিসিডিএস) প্রভাবশালী কতিপয় কর্মকর্তাদের কারণে দোষীদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননা।
এ ঘটনায় হাসপাতালের অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শেখ ফরিদ উদ্দিন ও রোগীর স্বামী শাহিন আলম দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগ পেয়ে কেএমপির ডিবি পুলিশের একটি টিম হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। অপরদিকে খুলনার কতিপয় ফার্মেসি ভেজাল ওষুধে সয়লাব। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যরা নগরীতে ভেজাল ওষুধের সন্ধান পাচ্ছেন। খুলনা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল- সবখানেই ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ভেজাল, মানহীন ও নকল ওষুধ।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, রোগীর স্বামী ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমার কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছেন। কেএমপি ডিবি পুলিশের কাছে অভিযোগটি প্রেরণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
এ ব্যাপারে কেএমপির গোয়েন্দা বিভাগের অতিঃ উপ-পুলিশ কমিশানর এ এম কামরুল ইসলাম পিপিএম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে।
খুমেক হাসপাতালের অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শেখ ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ তার লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, ৩ মার্চ মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে হাসপাতালে গাইনী ওয়ার্ড-৩ এর ভর্তিকৃত রোগী জুলিয়া আকতার (২৬) অপারেশন করার জন্য অপারেশন থিয়েটারে আসেন। অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ হ্যালোথেন (সংশ্লিষ্ট) হাসপাতালে সরবরাহ না থাকায় রোগীর স্বামী শাহিন আলমকে ১শ’ গ্রাম হ্যালোথেন ওষুধটি বাইরে থেকে সংগ্রহ করার জন্য বলা হয়। রোগীর স্বামী বাইরে থেকে কিনে আনা হ্যালোথেন ব্যবহারের সময় দেখা যায় হ্যালোথেন নয় কেরোসিন তেল। যা রোগীর শরীরে প্রবেশ করা মাত্র মৃত্যু অবধারিত এবং সাথে সাথে অ্যানেসথেসিয়া মেশিনটি আগুন ধরাসহ বড় ধরনের ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো বলে চিকিৎসক মনে করেন। রোগীর স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, খুুমেক হাসপাতালের সামনে শাওন মেডিকেল হলের প্রতিনিধি তন্ময়ের মাধ্যমে নিপা মেডিকেল হলের মিরাজের এর নিকট হতে হ্যালোথেন ক্রয় করে নিজ নাম্বারে বিকাশের মাধ্যমে ৩ হাজার ২৬৫ টাকার বিল পরিশোধ করেন। জানা গেছে, সোনাডাঙ্গা থানার বর্তমানে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির (বিসিডিএস) এক প্রভাবশালীর কর্মকর্তার আপন ভাগ্নে মিরাজুল ইসলাম হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এর আগে ডিবি পুলিশের একটি টিম নিপা মেডিকেলের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ থাকায় অভিযান পরিচালনা করেন।
রোগীর স্বামী শাহিন আলম খুমেক কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, তিনি গত ২ মার্চ তার স্ত্রী জুলিয়া আকতারকে খুমেক হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। ওই দিন তার স্ত্রীকে চিকিৎসকরা অপারেশন করার পরামর্শ দেন। সেই মোতাবেক ওই দিন রাতে হাসপাতালের সামনে শাওন মেডিকেল হলের প্রতিনিধি তন্ময়ের মাধ্যমে নিপা মেডিকেল হলের মিরাজের নিকট হতে হ্যালোথেন বিকাশের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করে ক্রয় করেন। পরের দিন ৩ মার্চ তার স্ত্রীকে অপারেশনের জন্য ক্রয় করা হ্যালোথেন অ্যানেসথেসিয়া মেশিনে দিতে গিয়ে দেখেন তা কেরোসিন তেল।
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, এর আগেও খুমেক হাসপাতালের সামনে থেকে হাইএন্টিবায়োটিক মেরোপেনাম-১ গ্রাম, আইপেনাম-১ গ্রাম, সেফটন-২ গ্রাম, ট্রাকশন-২ গ্রাম, ইনজেকশন প্র্যারাডক্স (বিষ খাওয়া রোগীদের জন্য) এ সমস্ত জীবন রক্ষাকারী নকল ও ভেজাল ওষুধ ২০১৬ সালে উদ্ধার করা হয়। যা তৎকালীন খুলনা ড্রাগ সুপারের কাছে জমা দেওয়া হয়। জানা গেছে, এক্সপিন-১ গ্রাম দিয়ে মেরাপেনাম ও আইপেনাম নকল ইনজেকশন তৈরি হতো। আর খাবার স্যালাইন দিয়ে তৈরি করা হতো প্র্যারাডক্স।
গোয়েন্দা সূত্র মতে, নগরীর ক্লে রোডে হেরাজ মার্কেট পাইকারী ওষুধ বিক্রির বাজার হিসেবে পরিচিত। এ মার্কেটে ফিজিসিয়ান শ্যাম্পল, সরকারি বিক্রি নিষিদ্ধ ওষুধ, অনিবন্ধিত, নি¤œমান, মেয়াদোত্তীর্ণ, ফুড সাপ্লিমেন্ট, হারবাল ও ভারতীয় নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজক ওষুধ অসাধু ব্যবসায়ীরা বিক্রির সাথে জড়িত রয়েছেন। বিভিন্ন অভিযানে ওষুধ আটক ও জরিমানাও করা হচ্ছে। খুলনা কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দোকানে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যাচ্ছে বিক্রয় নিষিদ্ধ ওষুধ। তার পরেও থেমে নেই এই সব ব্যবসা। এ কারণে অনেক সময় ড্রাগ প্রশাসনের কর্মকর্তারা অবৈধ ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে তখনই ওই সমিতির লোকজন শেল্টার দিয়ে থাকেন। যার কারণেই অভিযান সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না ভেজাল ও নিষিদ্ধ ওষুধের কেনাবেচা।
গত বছর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জাকির হোসেন এর নেতৃত্বে র্যাবসহ হেরাজ মার্কেটে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই সময় অভিযানে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ও ফিজিসিয়ান স্যাম্পল থাকার অপরাধে দুইটি ফার্মেসিকে জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর মধ্যে হেনা মেডিকেল হলকে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ থাকার অভিযোগে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক খুলনা জেলা শাখার সাবেক বিসিডিএস (অবৈতনিক) সম্পাদক এস এম আজিজুর রহমান। এর আগে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য অধিদফতর, ওষুধ ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে নগরীর পাইকারী ওষুধের বাজার হেরাজ মার্কেটে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে খুলনা কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতির তৎকালীন সভাপতিসহ ১৬ জন ব্যবসায়ীকে ১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিলো।