কামরুল হোসেন মনি, খুলনা : খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের হাতে সাধারণ রোগীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ওষুধ প্রতিনিধিদের কারিশমা আর ডাক্তারদের বাণিজ্যিক মনোভাবে চিকিৎসা সেবা প্রশ্নবিদ্ধ। ওষুধ প্রতিনিধিদের হাসপাতালে আউটডোর-ইনডোরের ডাক্তারদের রুমে সর্বক্ষণিকের যাতায়াত রয়েছে। নিয়ম বর্হিভুতভাবে ওষুধ প্রতিনিধিদের ভিজিট করা নিয়ে রোগীদের সাথে হচ্ছে হাতাহাতি ও লাঞ্ছিতের ঘটনা।
খুমেক হাসপাতালে বৃহস্পতিবার সকালে এক মহিলা রোগীকে (স্টোকজনিত) ভর্তি করার পর চিকিৎসকের টেবিলে সামনে ওষুধ প্রতিনিধিরা তাদের কোম্পানীর ওষুধ লেখা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। এ অবস্থা দেখে প্রতিবাদ করায় ওই রোগীর স্বজনকে মারার জন্য তেড়ে আসেন এবং তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এর আগে শহীদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগী দেখার সময় ডাক্তারের চেম্বারে ভিজিট করার প্রতিবাদ করায় এক রোগীকে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের কাছে কিছু অসাধু চিকিৎসক আর্থিকসহ বিভিন্ন সুবিধা নেওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করার নজির নেই। মাঝে মধ্যে এ বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় লেখা-লেখি হওয়ার পর কিছুদিন নিরব থাকলেও পরে একই চিত্র দেখা যায়।
বৃদ্ধা মা আঞ্জুমান আরা (৪৫)। বুধবার রাতে স্টোকে আক্রান্ত হন। ছেলে মসজিদের ঈমাম মহসিন উদ্দিন তার মা’কে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে খুমেক হাসপাতালে মেডিসিন ইউনিট-২ এর ৭ ও ৮ ওয়ার্ডে ভর্তি করান। চিকিৎসক তার মা কে দেখার পর, ওষুধ প্রেসক্রিপশন করার সময় ৭-৮ জন বিভিন্ন কোম্পানীর ওষুধ প্রতিনিধিরা চিকিৎসকের টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এ সময় প্রতিযোগিতা নেমে যান ওষুধ প্রতিনিধিরা। তাদের কোম্পানীর ওষুধটা ব্যবস্থাপত্রে লেখার।
রোগীর ছেলে মহাসিন উদ্দিন বলেন, এক সাথে ৫-৬ জন ওষুধ প্রতিনিধিরা তাকে মারার জন্য সামনে চলে আসেন। তার পেকট চেক করেন। তুই কে, তুই আমাদের চিনিস। এ রকম নানান ধরনের অশুভ আচরন করতে থাকেন তার সাথে।
খুমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ এ টিএম মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, আমি এখন ছুটিতে আছি। আসার পর ওষুধ প্রতিনিধিরে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তিনি বলেন, আগে আমার হাসপাতালের রোগীদের সঠিক সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব। যাতে তারা কোন ধরনের হয়রানী শিকার না হন।
খুমেক হাসপাতালে মেডিসিন উইনিট-৪ এর সিনিয়র কনসালটেন্ট শেখ মামুন অর রশিদ এ ব্যাপারে বলেন, আমার ইউনিটে চিকিৎসকদের বলা আছে, রোগীর দেখার সময় কোন ওষুধ প্রতিনিধি ওয়ার্ডে আসতে পারবে না। সপ্তাহ তিন দিন হাসপাতালে ওষুধ প্রতিনিধিরা ভিজিট করবে দুপুর ১টার পরে। ওই সময় যদি রোগীর চাপ থাকে, তখনও ঢুকতে পারবে না।
বৃহস্পতিবার মেডিসিন ইউনিট-২ এ গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালে ইর্ন্টানী চিকিৎসকদের পাশে দাড়িয়ে রয়েছেন ৬-৭ জন ওষুধ প্রতিনিধিরা। দরজার বাইরে রয়েছে ওষুধ প্রতিনিধিরে ব্যাগও। ভর্তি এক রোগীর স্বজন ভিতরে ঢুকে ডাক্তারের পরামর্শ নেবে তারও কোন উপায় নেই। হাসপাতালে প্রায়ই ওয়ার্ডের ডক্টরসদের রুমে এই একই চিত্র লক্ষ্য করা যায়। ডাক্তারদের রাউন্ডের সময় রোগীর স্বজনরা এলাও না হলেও ওষুধ প্রতিনিধিরা ঠিকই ঢুকে যাচ্ছেন। মিডিসিন ইউনিট-৪ এর একই চিত্র রয়েছে। ওই ওয়ার্ডে যেদিন রোগীর ভর্তির দিন পরে সেখানে সকাল থেকে রাত অবধি বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা আগে থেকে এসে বসে থাকেন। সাধারন রোগীরা দেখলেও ভয়ে কোন প্রতিবাদ করতে সাহস পাননা। মেডিসিন ইউনিট-৪এর সহকারি রেজিস্ট্রটার ডাঃ স্বরুপ চন্দ্র পোদ্দারের বিরুদ্ধে রোগীদের সাথে অশুভ আচরনসহ তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ফুলতলা উপজেলা আলকা গ্রামের বাসিন্দা রোগী এসএম বুলবুল আহমেদ শহীদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসলে হাসপাতালে থাকা ওষুধ প্রতিনিধিদের হাতে লাঞ্ছিত হন। এ সময় ওই রোগীকে কয়েকজন ওষুধ প্রতিনিধিরা লাঞ্ছিতসহ জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী এস এম বুলবুল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এ ঘটনায় হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ ওষুধ প্রতিনিধিদের ভিজিট সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেন। এছাড়া দোষীদের বিরুদ্ধে আজীবন হাসপাতালে প্রবেশের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন।