কামরুল হোসেন মনিঃ খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে জন্মলগ্ন থেকে মানসিক রোগ বিভাগ থাকলেও অদৃশ্য কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। পাশাপাশি গ্যাস্ট্রো, নিউরো মেডিসিন, রেসপিরেটরী মেডিসিন, হেপাটলোজী ও এন্ড্রোক্রাইনোলজীর আলাদাভাবে কোন বিভাগ ছিল না। ফলে ওই সব রোগে আক্রান্ত সাধারণ রোগীদের বহিঃবিভাগ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েই বাড়ি ফিরে যেতে হতো। এখন থেকেই তারা বহিঃ ও আন্তঃবিভাগে ওই সব বিভাগ থেকে সাধারণ রোগী চিকিৎসা পেতে শুরু করেছে। নিউরো মেডিসিন বিভাগে রোগীর তুলনায় বেড স্বল্পতা থাকার কারণে ওই বিভাগের বেড সংখ্যা আরও বৃদ্ধির দাবি উঠেছে। এর আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ এটি এম এম মোর্শেদ’র সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০টি বেডের মানসিক বিভাগ চালুর উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য আলহাজ মিজানুর রহমান মিজান।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ এটি এম মঞ্জুর মোর্শেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, এই হাসপাতাল চালুর পর থেকেই মানসিক রোগীদের জন্য আলাদা কোন বিভাগ ছিল না। রোগীরা বহিঃবিভাগ থেকে চিকিৎসা পেতো। এতে অনেক হতদরিদ্র রোগী টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে হিমশিম খেতেন। এখন থেকেই মানসিক রোগীরা সব ধরনের চিকিৎসা সেবা এই হাসপাতাল থেকেই পাবেন। এর আগে আমি আসার পর গ্যাস্ট্রো, নিউরো মেডিসিন, রেসপিরেটরী মেডিসিন, হেপাটোলজী ও এন্ড্রোক্রাইনোলজী বিভাগ চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে যাতে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার কোন ত্রুটি না হয়, সেই জন্য যা যা করার দরকার সব কিছুই ধীরে ধীরে চালু করা হবে। ভবিষ্যতে এই হাসপাতালটি খুলনা বিভাগের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় একটি নতুন রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। এই জন্য তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা করেন।
খুমেক হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডাঃ এস এম ফরিদুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, হাসপাতালের জন্মের পর থেকে আলাদাভাবে মানসিক বিভাগ চালু ছিল না। মানসিক রোগীরা আসলে তখন শুধু বহিঃবিভাগ থেকেই চিকিৎসা পেতো। অনেক সময় হতদরিদ্র পরিবার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতেন। এখন বহিঃ ও আন্তঃবিভাগে মানসিক রোগীরা চিকিৎসা পাবেন। এছাড়া যাবতীয় মানসিক রোগীদের সব ধরনের সেবা দেওয়া হবে। এতে সুবিধা বঞ্চিত হতদরিদ্র রোগীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। ৫টি পুরুষ ও ৫টি মহিলা বেড নিয়ে এই বিভাগের যাত্রা শুরু।
মানসিক রোগ বিভাগের সিনিয়র স্টাফ নার্স কাকলী রানী কু-ু বলেন, গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে রো13
গীর ভর্তি শুরু হয়। আর আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ ফেব্রুয়ারি বিভাগ চালুর উদ্বোধন করা হয়। এ পর্যন্ত পুরুষ ও মহিলা মিলে ৭ জন মানসিক রোগী চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
ওই বিভাগে কথা হয় মা শুভ্রা’র সাথে। পবিত্র ম-ল তার একমাত্র ছেলে মানসিক রোগী। ডুমুরিয়ার বাসিন্দা মৃত অরন্দ্রনাথ ম-লের পুত্র। মানসিক রোগী ছেলেটির মা বলেন, তার ছেলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিসারিতে অনার্স পাস করেছে। সারাদিন সে বই নিয়ে পড়ে থাকতো। কোথাও গেলেও বই সাথে থাকতো। কোন বাজে আড্ডাও ছিলো না। কয়েক মাস ধরে সে একা একা কথা বলে, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ডাক্তার দেখালেই বুঝতে পারি সে মানসিক সমস্যায় আছে। এখন একটু সুস্থ। অপর রোগী নাজমুল হুদার (২২) মা মনোয়ারা বেগম বলেন, তার ছেলে ৯ বছর থাকতেই মানসিক রোগী ছিল। বৃহস্পতিবার এ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি ছিল। এই ওয়ার্ড চালু হলে তাকে এখানে ভর্তি করা হয়। স্বামী আবুল কাশেম থেকেও নেই। দর্জির কাজ করে ছেলের চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছি।
ওই হাসপাতালে ৪র্থ তলায় গ্যাস্ট্রো, নিউরো মেডিসিন, রেসপিরেটরী মেডিসিন, হেপাটোলজী ও এন্ড্রোক্রাইনোলজী বিভাগ চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে নিউরো মেডিসিন বিভাগে ৭টি বেড, গ্যাস্ট্রোতে ৬টি বেড, রেসপিরেটরী মেডিসিন ৭টি বেড, এন্ড্রোক্রাইনোলজী ২টি বেড ও এন্ড্রোক্রাইনোলজীতে ৬টি বেড নিয়ে বিভাগগুলো চালু করা হয়েছে। এর আগে ওই সব রোগীদের জন্য আলাদা কোন ওয়ার্ড বা বিভাগ ছিল না।
নিউরো মেডিসিন বিভাগের ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স তানিয়া সুলতানা বলেন, রোগীর তুলনায় নিউরো মেডিসিন বিভাগে বেড সংখ্যা খুবই কম। প্রতিদিনই রোগী ভর্তি হওয়ার জন্য ১০-১২ জন রোগীর অভিভাবক সিরিয়াল দিয়ে রাখেন। অনেকে এসে ফিরে যাচ্ছেন। ৩টি পুরুষ ও ৪টি মহিলা বেড রয়েছে। রোগীরা চাপে থাকায় অনেক সময় রোগী বেড না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই ওয়ার্ডে আরও ১০-১৫টি বেড থাকলে কিছুটা চাপ কমবে বলে তিনি জানান।
নিউরো মেডিসিন বিভাগে ভর্তি নুরু মিয়া (৭৫)। বাগেরহাট মোরেলগঞ্জের বাসিন্দা। তার ছেলে নাসির উদ্দিন বলেন, তার বাবা স্ট্রোক করে এখনো জ্ঞান ফেরেনি। এই ওয়ার্ডে ৭ দিন আগে থেকে বাবার ভর্তির জন্য সিরিয়াল দিয়ে রাখি। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বেড খালি হলে তাকে এনে ভর্তি করা হয়। তিনি বলেন, নিউরো মেডিসিন বিভাগে রোগীর বরাবরই সব জায়গায় চাপ থাকে। কিন্তু রোগীর তুলনায় বেড স্বল্পতা থাকার কারণে তার মতো অনেকে সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারছেন না। যার ফলে বাইরে থেকে ট্রিটমেন্টের জন্য প্রচুর ব্যয় হয়ে যাওয়ায় অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন। তার মতো অনেক রোগীর অভিভাবকের দাবি খুব দ্রুত কর্তৃপক্ষ রোগীদের কথা বিবেচনা করে বেড সংখ্যা যেন বৃদ্ধি করেন।
নিউরো মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডাঃ শাহিন আক্তার এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিদিন এ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে ১শ’র মতো রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে নিউরো মেডিসিন রোগী থাকে ৩০-৪০ জনের মতো। মাত্র ৭টি বেড দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে পেয়িং বা কেবিনে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ওই ওয়ার্ডে বেড সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনবলের দরকার আছে। কাগজ-কালমে এই হাসপাতালটি ৫শ’ বেডের থাকলেও সেই অনুযায়ী নেই বেড ও জনবল।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৮ জুন থেকে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ এটি এম মঞ্জুর মোর্শেদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর পর থেকেই তিনি মানসিক রোগ বিভাগ চালুসহ ২৭টি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে হাসপাতালে নিয়মিত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত, রোগীদের খাবারের মান বৃদ্ধি, লাশঘর স্থানান্তর করা, দালাল প্রতারক প্রতিরোধ করা, ১টার পূর্বে ওষুধ প্রতিনিধিদের ভিজিট বন্ধ করা, প্যাথলজি বিভাগে স্যাম্পল কালেকশন সময় বৃদ্ধি করা, ব্লাড ব্যাংকের পাশে নতুন করে কক্ষ নির্মাণ, অনুমোদিত ৫শ’ শয্যার রোগীর পরিবর্তে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি থেকে ভর্তিকৃত সকল রোগীর খাবার ব্যবস্থা করা, ওয়ার্ড ইনচার্জদের দায়িত্ব পরিবর্তন করে নতুনদের দায়িত্ব অর্পণ করা, জখমি সনদপত্র প্রদানের জন্য বোর্ড গঠনপূর্বক কেবলমাত্র থানা ও আদালত থেকে চাহিদার প্রেক্ষিতে স্বচ্ছতার সঙ্গে জখমী সনদপত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
খুমেক হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ বেলাল হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক আসার পর থেকেই রোগীদের সেবা মান আরো উন্নত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রোগীদের খাবারের মান বৃদ্ধি করা। এছাড়া রোগীরা এখন থেকেই ভর্তি হলেই সকলের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা। সোমবার ৮শ’ এর ওপরে ভর্তিকৃত রোগীর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদি ১৫শ’ রোগী ভর্তি হতো তাহলে খাবারের ব্যবস্থা থাকবে, রোগী ভর্তি হলেই সেই রোগীর জন্য খাবার বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া মানসিক রোগ বিভাগ চালুসহ নানা পদক্ষেপ ইতোমধ্যে কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।