যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের অভিযোগ
বিদেশগামী যাত্রীদের ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ
মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস
অপচিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু
ইউনিক ডেস্ক : খুলনার চিকিৎসকরা অনৈতিকতাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে বিরূপ ধারণা। সম্প্রতি যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ, হত্যা প্ররোচনা, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, অপচিকিৎসায় সাংবাদিক পত্নীর মৃত্যু ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গুরুতর অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর নেতারা বলছেন, একটি আদর্শিকগত পেশায় অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংবরণ করা উচিত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি নিজ কর্মস্থান হক নার্সিং হোমে এক শিশু রোগীর মায়ের সঙ্গে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে। এছাড়া চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ঐ নারীকে মারধরেরও অভিযোগ করা হয়। উক্ত ঘটনায় ঐ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী নারী থানায় মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনার পর চিকিৎসকরা টানা চার দিন কর্মবিরতি পালনসহ আন্দোলন করে। এতে ঐ চারদিন খুলনার চিকিৎসা সেবা ভেঙ্গে পড়ে। ঠিক পরের মাসে পেটে ব্যাথা জনিত কারণে দৈনিক জন্মভূমির স্টাফ রিপোর্টার মামুন খানের স্ত্রী শায়লা শারমিন (৩০) কে ১৩ মার্চ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনী চিকিৎসক ডাঃ সানজিদা হুদা সুইটির প্রাইভেট প্রাকটিসের স্থান গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে নেয়া হয়। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষার রিপোর্ট দেখে রোগীকে ওভারিয়ান সিস্টে আক্রান্ত বলে শনাক্ত করেন। ১৪ মার্চ রোগীর পেটে ভীষন ব্যাথা শুরু হলে তাকে গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে ডা: সুইটি তাকে অপারেশনের আগের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষার ব্যবস্থাপত্র দেন এবং ১৫ মার্চ দুপুর দেড়টায় অপারেশনের সময় নির্ধারণ করেন। দুপুর একটার পর ওয়ার্ড বয় এবং একজন আয়া শায়লাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। এরপর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান ডাঃ দিলিপ কুমার কুন্ডু তাকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দেন। দুপুর দু’টা ১২-১৩ মিনিটের দিকে ডাঃ সুইটি ওটিতে প্রবেশ করেন এবং বেরিয়ে বলেন, রোগীর কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছে। পরে সেটা রিকভারি হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন এবং তাকে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন শেষে আইসিইউতে রেখে চলে যান। সেখানে আট দিন এবং পরবর্তীতে শহীদ শেখ আবু নাসের বিশাষায়িত হাসপাতালে তিন দিন থেকে মৃত্যু বরণ করেন। ঐ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে গত ৬ জুন নিজ চেম্বারে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. বিপ্লব কুমার দাসের বিরুদ্ধে। কথিত আছে সেই দিনের ঘটনা মোটা অংকের টাকা দিয়ে ধামা চাপা দেন ডা. বিপ্লব। তবে বহুল পরিচিত দুই চিকিৎসকের এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড শহরজুড়ে সমালোচিত হয়। এর আগে নিজ স্ত্রীর কথা গোপন রেখে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দৈহিক সম্পর্ক ও পরবর্তীতে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানালে আত্মহত্যা করেন নগরীর গাজী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. মন্দিরা মজুমদার। গত বছরের ২৮ এপ্রিলের ঐ ঘটনায় খুমেক হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার ও তার বোন সিঁথি মনি হালদারকে আসামি করে আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলা করা হয়। বর্তমানে মামলাটির অধিকতর তদন্ত করছে মহানগর পুলিশের অপরাধ তদন্ত শাখা সিআইডি।
ডা. মন্দিরার পিতা প্রদীপ মজুমদার বলেন, আমাদের মেয়েকে ডা. সুহাস বিয়ে করবে- এ কথা সে ও তার বোন নিজ মুখে আমাকে বলেছিলো। সেইভাবে তারা মেলামিশা করতো। এর এক পর্যায়ে আমার মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। পরে আমরা আনুষ্ঠানিক বিয়ের জন্য ডা. সুহাসকে চাপ দিলে সে সব কিছু অস্বীকার করে জানায় তার বউ রয়েছে। এই অপমান ও লোকলজ্জা সইতে না পেরে আমার মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আমি এ ঘটনার ন্যায় বিচার চাই।
সর্বশেষ গত চার দিন ধরে খুলনার টক অব দ্যা টাউনে পরিণত হয়েছে মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের পাঁচ চিকিৎসকের জড়িত থাকার অভিযোগ। গত ১৮ আগস্ট নগরীর বাইতিপাড়ার নিজ বাসা থেকে ঢাকার সিআইডি সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় খুমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার, থ্রি ডক্টর মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক, স্বাচিপ নেতা ও খুলনা বিএমএ’র নির্বাহী সদস্য ডা. ইউনুস উজ্জামান খান তারিমকে। এছাড়া ঐ দিন বিভিন্ন সময়ে একই অভিযোগে সিআইডির সদস্যরা নিজেদের বাসা থেকে আটক করে খুমেক হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. লুইস সৌরভ সরকার, ডা. নাজিয়া মাহজাবিন তিশা, ডা. শর্মিষ্ঠা মণ্ডল ও ডা. মুসতাসিন হাসান লামিয়াকে। ঐ চারজন চিকিৎসকের পরিবারের সদস্যরা বলেন, গত শুক্রবার ভোরে সুনির্দিষ্ট কারণ না দেখিয়ে সিআইডি পরিচয়ে সাদা পোশাকে তাদের তুলে নেওয়া হয়েছে। তারা কোথায় আছেন, কেমন আছেন- তা পরিবারের সদস্যরা জানতে পারছেন না। ফলে আমরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ডা. ইউনুস খান তারিম মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। তিনি তার মালিকানাধীন থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁস করে গত ১৬ বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। ডা. তারিম খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিয়ে মেডিক্যালের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র গড়ে তুলেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে এক প্রতিবেদনে বলেছে, খুলনার উক্ত কোচিং সেন্টার ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে ‘মেধাহীন’, ‘অযোগ্য’ ছাত্রছাত্রীদের মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা জনপ্রতি ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা করে নেয়। এই ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে বছরে শতকোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেন হয়। এ বিষয়ে খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান আল মামুন বলেন, ডা. তারিমকে ঢাকার সিআইডি টিম আটক করেছে। তবে বাকি চারজনের বিষয়ে আমার জানা নেই।
অপরদিকে খুলনার সদ্যবিদায়ী সিভিল সার্জন (সিএস) ডা. সুজাত আহমেদ, সাবেক সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ ও খুলনা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. এস এম মুরাদ হোসেনসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে করোনাকালীন পরীক্ষার জন্য বিদেশগামী যাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন। এ ঘটনায় তাদের নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করেছে। ইতিমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
চিকিৎসা পেশার মতো মহৎ পেশায় থাকা ডাক্তাররা কেন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন- এ ব্যাপারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) মানব সম্পদ উন্নয়ন ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক প্রসেনজিৎ তরফদার বলেন, নানাবিধ কারণে এসব হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে অপরাধ করে কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যাওয়া, প্রভাবশালী মানুষের সংস্পর্শে থাকা এবং বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়া। তবে পারিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্কে না থাকাসহ আরো বেশ কিছু কারণও এর সঙ্গে জড়িত থাকে।
এ বিষয়ে খুলনা বিএমএ সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম বলেন, অনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। এছাড়া কিছু বিষয় আছে বিচারাধীন। তাই বিচার প্রক্রিয়া শেষে জানা যাবে আসলে তারা দোষী কি না।