কামরুল হোসেন মনি, খুলনা : শেখ মাসুদুর রহমান। খুমেক হাসপাতাল সামনে থেকে মটরসাইকেল স্ট্যাড দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ সময় পেছন থেকে আসা একটি ইজিবাইক তাকে ধাক্কা দিলে রাস্তায় সিটকে পড়েন। ইজিবাইকের ধাক্কায় তার ডান হাতের একটি আঙ্গুল ভেঙ্গে যায়। তাকে খুমেক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। শুধু মাসুদুর রহমান না, এরকম প্রতিনিয়ত নগরীর বিভিন্ন স্থানে ইজিবাইকের বেপরোয়া চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। ওই সব যানবাহন রোধের বিষয়টি বিভিন্ন সভায় আলোচিত হলেও সমাধানে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেই।
খুলনা জেনারেল হাসপাতালে জরুরী বিভাগ থেকে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৯৫০ জন বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখান থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে আহতরা অধিকাংশই ইজিবাইকের সাথে দুর্ঘটনার শিকার বলে হাসপাতাল সূত্র জানা যায়। এছাড়া খুমেক হাসপাতালেও প্রতিনিয়ত কোন না কোন স্থান থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রোগীরা সেবা নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে কেএমপি’র ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোঃ কামরুল ইসলাম সোমবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে আনুমানিক ২৫-৩০ হাজার নগরীতে ইজিবাইক চলাচল করছে। তিনি বলেন, কেসিসি’র থেকে ৫ হাজার ইজিবাইকগুলোর আলাদা কালার করে মার্কিং করে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি, যদি হতো তাহলে আমাদের ফোর্স নিয়ে মার্কি ছাড়া ইজিবাইকগুলো আইনে আওতায় আনতে পারতাম। যদি অবৈধ ইজিবাইক বন্ধের জন্য কেসিসি’র পক্ষ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে উদ্যোগ নিতো তাহলে আমরা পুলিশের সহায়তায় তাদেরকে আমরা সহযোগিতার জন্য সব সময় প্রস্তুতি আছি। খুমেক হাসপাতালের সামনে যানজট নিরসনে একজন ট্রাফিক সদস্য নিয়োজিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জনবল সংকট থাকায় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সরেজিমনে দেখা গেছে, ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক ও রিক্সা চালকদের অধিকাংশই বেপরোয়া। ওই সব চালকেরা বিশেষ করে ইজিবাইক নিয়মকানুনের ধার ধারে না। কোন ধরনের আগাম সিগনাল ছাড়াই রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করা। নগরীর বিভিন্ন মোড়ে এমনকি ছোট রাস্তাগুলোতেও ইজিবাইক ও রিক্সা ইচ্ছামতো দাড় করিয়ে রাখা হয়। এতে পথচারীরা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে ব্যাটারি চালিত রিক্সা বেপরোয়া গতিতে শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ বাহনটি হালকা হওয়ায় দ্রুতগতি নিয়ন্ত্রণ করার সময় প্রায়ই দুর্ঘটনার খবর শোনা যায়। সম্পুর্ণ বেআইনীভাবে রিক্স্রায় ইঞ্জিন লাগিয়ে রাস্তায় নামনো হচ্ছে। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অবৈধ ইজিবাইক ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা নগরীতে চলাচলের অভিযোগ রয়েছে। অনেক প্রভাবশালীর ব্যক্তির অবৈধ ইজিবাইক ও রিক্সা চলাচল করছে।
কেসিসি’র যনাবহান শাখার লাইসেন্স অফিসার খান হাবিবুর রহমান সোমবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদককে বলেন, তৎকালীন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক নগরীতে ইজিবাইক চলাচলের জন্য মাত্র ১ হাজার ৯৬৩টি লাইসেন্স প্রদান করেন। এরপর আরও কোন লাইসেন্স দেয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পূর্ব লাইসেন্সকৃতদের নবায়নও করা হয়নি। এছাড়া নগরীতে লাইসন্সেকৃত রিক্সার সংখ্যা রয়েছে ১৭ হাজার। এর পরে আর কোন লাইসেন্স দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, সম্প্রতি স্থানীয় এমপি ও প্রশাসনের উদ্যোগে নগরীতে কতগুলো ইজিবাইক চলাচল করতে পারবে। ওই সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল আরও ৩ হাজার ইজিবাইক অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে নগরীতে ইজিবাইক ও রিক্স্রা সংখ্যা কত আছে তা তিনি সঠিক বলতে পারেননি।
জানা গেছে, বর্তমানে খুলনা মহানগরী এলাকায় প্রায় ৩০-৩৫ হাজার ইজিবাইক চলাচল করছে। এর মধ্যে তৎকালীন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক প্রায় ২ হাজার ইজিবাইক চলাচলের অনুমোদন দিয়েছিলেন। বাকি ইজিবাইকগুলোর নগরীতে চলাচলের কোন প্রকার বৈধতা নেই। নগরীতে লাইসেন্সকৃত রিক্সার সংখ্যা হচ্ছে ১৭ হাজার থাকলেও চলাচল করছে ৩০ হাজারের অধিক। এর মধ্যে বহু নতুন ও পুরনো মডেলের রিক্সায় অবৈধভাবে ব্যাটারিচালিত ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়েছে।
খুলনা জেনারেল হাসপাতাল সূত্র মতে, নগরীতে বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রোগীরা সেবা নিচ্ছেন। এর মধ্যে ইজিবাইকের সাথে দুর্ঘটনার সংখ্যাই বেশি। ওই সূত্র মতে, গত ২০১৬ সালে জানুয়ারিতে ৭২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৯ জন, মার্চে ৫৫, এপ্রিলে ৩০, মে ৪৩, জুনে ৪৪, জুলাইতে ৩৭, আগষ্টে ৩৮, সেপ্টেম্বরে ৩৩, অক্টোবরে ৫২, নভেম্বরে ২৬ ও ডিসেম্বরে ৩৩ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। এছাড়া ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আরও ৪৪৮ জন নারী পুরুষ ও শিশুসহ বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন।
জানা গেছে, নগরীতে যানজট নিরসনে গত বছর মে মাসে খুলনার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ একটি সভার আহবান করেন। সভায় সভায় স্থানীয় সংসদ সদস্য, খুলনা সিটি কর্পোরেশন মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও খুলনা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় ইজিবাইকের সংখ্যা ৫ হাজারে নামিয়ে আনা ও ইজিবাইক শো-রুম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের এখনো আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে চলতি বছরে নগর ভবনে ইজিবাইক ও যানজট নিরসন সংক্রান্ত বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কেসিসি’র মেয়র মনিরুজ্জামান মনির সভাপতিত্বে বৈঠকে খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে পূর্বের দেয়া ইজিবাইক লাইসেন্স এর সাথে আরও ৩ হাজার অনুমতির বিষয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। যে সব লাইসেন্স দেয়া হবে সেই ইজিবাইকগুলোকে সবুজ রং দিয়ে মার্কিং সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে নগরীর স্থানীয় বাসিন্দা চালক এমন লোক অগ্রাধিকার পাবে। এর বাইরে জেলায় এবং জেলার ইজিবাইক নগরীতে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু ওই সব সিদ্ধান্তগুলো এখনো আলোরমুখ দেখেনি।