খুলনা : খুলনায় মরণনেশা মাদক ব্যবসার সঙ্গে ২৭২ জন ব্যক্তির জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের এক সাংসদ, আরেক সাংসদের দুই ভাই, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও মোটরশ্রমিক লীগের নেতা এবং বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি। এই পুরো মাদক চোরাকারবার ও সরবরাহে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন ৩৪ জন পুলিশ সদস্য।
মোট ৩৪৬ জনের এমনই একটি তালিকা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে খুলনায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ, জনপ্রতিনিধি ও নেতা, পুলিশ, সাংবাদিকসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নাম থাকায় ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
খুলনা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান জানান, তালিকার সিংহভাগই সরকারি দলের নেতা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিক। তাই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না তারা। তবে, তালিকায় থাকা ছোটখাটো মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে খুলনার পুলিশ।
ওই তালিকায় থাকা কারো নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি উপপরিচালক। তবে এনটিভি অনলাইনের এই প্রতিবেদকের কাছে ওই তালিকার কপি রয়েছে।
যেভাবে তালিকা
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সরকারের তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা গত বছর পুরো খুলনায় তদন্ত করে মাদক ব্যবসায়ী, এর পৃষ্ঠপোষক ও সহায়তাকারীদের তালিকা তৈরি করে। এরপর তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এরপর আবার তদন্ত ও যাচাই-বাছাই করে ৩৪৬ জনের তালিকা পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর তালিকাটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) গত ১৫ মার্চ, ১৭৪ নম্বর স্মারকের ওই তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য খুলনা জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়কে আদেশ দেন।
এমপির নাম ৯ নম্বরে
তালিকাকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমেই আছে খুলনা জেলা, এরপরে আছে খুলনা মহানগর। এই দুটি ভাগে আবার তিন শ্রেণির লোকজনের নাম দেওয়া আছে। প্রতিটি ভাগের শুরুতে মাদক ব্যবসায়ী/চোরাকারবারিদের নাম ও ঠিকানা দেওয়া আছে। মধ্যে আছে মাদক ব্যবসায়ী/চোরাকারবারিদের পৃষ্ঠপোষক/আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদের নাম ও ঠিকানা। শেষে আছে মাদক চোরাকারবারে ও সরবরাহে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তাকারী স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নাম ও ঠিকানা।
খুলনা মহানগরে মাদক ব্যবসায়ী/চোরাকারবারিদের পৃষ্ঠপোষক/আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদের নাম ও ঠিকানা তালিকায় নয় নম্বরে রয়েছে খুলনা-২ আসনের সাংসদ ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মিজানুর রহমান মিজানের নাম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে জানান, মাদক বিরোধী বলে নগরবাসীর কাছে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। কেউ ভুল তথ্য দিয়ে তাঁর নাম তালিকায় এনেছে। এ ছাড়া এরই মধ্যেই একটি মহল তাঁকে নিয়ে চক্রান্ত করছে বলে অভিযোগ করেন মিজানুর রহমান।
বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে প্রতিবাদ জানাবেন বলেও জানান এমপি মিজান। এদিকে, সম্প্রতি অবৈধ সম্পত্তির অর্জনের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই এমপির বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
খুলনা মহানগরে মাদকের পৃষ্ঠপোষক ২৮ জন!
খুলনা মহানগরে মাদক ব্যবসায়ী/চোরাকারবারিদের পৃষ্ঠপোষক/আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদের নাম ও ঠিকানার তালিকায় ১ নম্বরে আছে খুলনা সদর থানাধীন ৫ নম্বর মাছঘাট শ্রমিক লীগের সহসভাপতি মো. বাবুল শেখের নাম। এরপরে যথাক্রমে খুলনা সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য শামসুজ্জামান মিয়া স্বপন, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগ সমর্থক মো. শামসু (২৮), খুলনা মহানগর শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গদা ইউনুচ মুন্সী, ২১ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সদস্য ও ১৩৮ খাদ্য গুদাম ওয়াকার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. ভাসান (৪০), মহানগর আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক হাফেজ শামীম ও খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আসাদুজ্জামান রাসেলের নাম।
এ ব্যাপারে এস এম আসাদুজ্জামান রাসেল এনটিভি অনলাইনের কাছে দাবি করেন, তিনি কোনো বিড়ি-সিগারেট খান না। সেখানে মাদকের তালিকায় তাঁর নাম কীভাবে এলো এটি তিনি জানেন না। প্রতিপক্ষ তাঁকে ফাঁসাতে এই কাজ করেছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে, তালিকায় বেশ কিছু নাম ঠিক আছে বলে জানান ছাত্রলীগের এই নেতা।
খুলনা মহানগরে মাদক ব্যবসায়ী/চোরাকারবারিদের পৃষ্ঠপোষক/আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদের নাম ও ঠিকানার তালিকায় খুলনা-৩ আসনের সাংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের দুই ভাইয়ের নাম আছে। এঁদের মধ্যে ভাই শাহবুদ্দিনের নাম আছে ১৫ নম্বরে। ফুপাত ভাই মার্শালের নাম আছে ১৯ নম্বরে।
এ ছাড়া মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তালিকায় নাম রয়েছে ২১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. সেলিম মুন্সী, খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বিপ্লব (কয়েক বছর আগে শ্রমিক দল থেকে শ্রমিক লীগে যোগ দেন), ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবিদ উল্লাহ, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর আনিস বিশ্বাস, ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন খন্দকার, ট্রাক টার্মিনাল কাঁচাবাজার সমিতির সেক্রেটারি কালা মনির, দৌলতপুরের আরাফাত সানি সোহাগ, কামরুল মাতুব্বর, বিএল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মো. রাকিব মোড়ল, খালিশপুরের যুবলীগ নেতা ইয়াসির আরাফাত হোয়াইট, ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শেখ খালেদ হোসেন, হরিণটানার সাবেক যুবলীগ নেতা মো. হাফিজুর রহমান হাফিজ, ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এফ এম জাহিদ হাসান জাকির, খানজাহান আলী থানা মোটর শ্রমিক লীগের সদস্য বাদশা মিয়া, খানজাহান আলী থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক হেলাল শরীফ, আড়ংঘাটার আবদুর রাজ্জাক শেখ, আড়ংঘাটার আওয়ামী লীগ সমর্থিত ইউপি চেয়ারম্যান মো. মফিজুর রহমান জিবলু ও আড়ংঘাটার মো. কাওসার মোড়লের।
মাদক ব্যবসায় দুই ওসিসহ ৩৪ পুলিশ সদস্য!
খুলনা জেলা ও মহানগরে মাদক চোরাকারবারে ও সরবরাহে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন ৩৪ জন পুলিশ সদস্য। এঁদের মধ্যে জেলা পুলিশের দুই থানার দুই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ১২ জনের নাম আছে। বাকি ২২ জন খুলনা মহানগর পুলিশে (কেএমপি) কর্মরত। তালিকায় থাকা দুই ওসি হলেন ফুলতলা থানার আসাদুজ্জামান ও দিঘলিয়া থানার হাবিবুর রহমান।
জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান জানান, তাঁর এলাকায় কোনো মাদক ব্যবসা নেই। তারপরও নিয়মিত অভিযান চলে। তালিকায় তাঁর নাম আসা প্রসঙ্গে বিষয়টি তাঁর জানা নেই বলে জানান।
একই কথা জানান দিঘলিয়া থানার ওসি হবিবুর রহমান। মাদকের ব্যাপারে তাঁর জিরো টলারেন্স রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
তালিকায় থাকা অন্য পুলিশ সদস্যরা হলেন খুলনার রূপসা থানাধীন আইচগাতি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদ, রূপসা থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রবিউল ইসলাম, দাকোপ থানার এএসআই সবুর হোসেন, পাইকগাছা থানার এসআই মমিন, কয়রা থানার এসআই ইকবাল ও আজম, ডুমুরিয়া থানাধীন মাগুরঘোনা ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই নাহিদ হাসান ও এএসআই রবিউল, বটিয়াঘাটা থানার এসআই শফিকুল ইসলাম ও দিঘলিয়া থানার এসআই মধুসুদন।
এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার নিজামউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তালিকার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। নাম আসা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেএমপির যাঁরা জড়িত!
খুলনা মহানগরে মাদক চোরাকারবারে ও সরবরাহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তাকারী হিসেবে কেএমপির ২২ পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে। এঁদের মধ্যে প্রথমেই আছে খানজাহান আলী থানাধীন শিরোমনি পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল মো. শহীদুল ইসলামের নাম। এরপর রয়েছে যথাক্রমে একই থানার আটরা পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল মো. মিজান, দৌলতপুর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. মিকাইল হোসেন, দৌলতপুর থানাধীন মহেশ্বরপাশা ফাঁড়ির এএসআই মো. মেহেদী হাসান, খালিশপুর থানার এসআই কানাই লাল মজুমদার ও নুরু, সদর থানার এসআই শাহ আলম, সুব্রত কুমার বাড়ৈ ও আশরাফুল আলম, সোনাডাঙ্গা থানার এএসআই এমদাদুল হক ও নুরুজ্জামান, লবণচরা থানার এসআই বাবুল ইসলাম, লবণচড়া পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. ওসমান গনি, লবণচরা থানার এএসআই আবদুল্লাহ আল মামুন ও মনজিল হাসান, হরিণটানা থানার এএসআই মোহাম্মদ রিপন মোল্লা, সদর থানার এসআই টিপু সুলতান ও মিলন কুমার, খানজাহান আলী থানার এসআই রাজ্জাক, ইলিয়াস ও সুমঙ্গল।
এই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেএমপির মুখপাত্র এডিসি সোনালী সেন। তিনি জানান, অভিযুক্ত যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা জেলায় মাদকের পৃষ্ঠপোষক ১২ জন!
খুলনা জেলার নয়টি উপজেলায় মাদক ব্যবসায়ী/চোরাকারবারিদের পৃষ্ঠপোষক/আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদের নাম ও ঠিকানার তালিকার প্রথমেই আছে তেরখাদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামানের ভাই ও তেরখাদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এফ এম মহিদুজ্জামানের নাম। এরপর রয়েছে যথাক্রমে ওয়াহিদুল ইসলাম ফকির, তেরখাদার মাসুম মোল্লা, রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. লিটন ঢালী, জেলা যুবলীগের সিনিয়র সহসভাপতি আজিজুল হক কাজল, রূপসার ঘাটভোগ ইউপির চেয়ারম্যান সাধন অধিকারী ও দাকোপ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রতন মণ্ডল, দাকোপের চালনা বাজারের আয়নাল হাওলাদারের নাম। আয়নাল তাঁর স্ত্রী ও জেলে উজ্জ্বল শেখকে মাদক চোরাচালানে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সহায়তা করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া তালিকায় রয়েছে দাকোপের বানিয়াশান্তা বাজারের আজিজ হাওলাদার, দিঘলিয়ার সেনহাটির মঈনুল হক জুয়েল (সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মশিউরের লোক), মশিউরের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এম এ রিয়াজ কচির বড় ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এম এ রেজা বাচা ও দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউপির চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেনের নাম।
মাদক ব্যবসায় জড়িত যাঁরা
খুলনায় মাদক ব্যবসা ও মাদক চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত ২৭২ জন ব্যক্তি। এর মধ্যে ১১৮ জন জেলা ও ১৫৪ জন মহানগরের।
এই ১১৮ জনের মধ্যে তেরখাদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি চালক আল আমিনের নাম রয়েছে তালিকার ২৩ নম্বরে। এ ছাড়া রয়েছে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাবেক ইউপি সদস্য সুব্রত বাগচি, রূপসা থানার বিএনপি সমর্থক ও জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক রিপন বিশ্বাস, দাকোপের বানিয়াশান্তা যৌনপল্লীর সর্দারনি জাহানারা পারভিন, কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ ও বটিয়াঘাটা সদর ইউপি সদস্য মো. নজরুল ইসলামের নাম। এ ছাড়া এই তালিকায় দিঘলিয়ার দুজন সাংবাদিকের নাম রয়েছে। এঁরা হলেন সময়ের খবরের প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম ও লোক সমাজের প্রতিনিধি শেখ জামাল।
খুলনা মহানগরে মাদক ব্যবসায় জড়িতদের তালিকায় ১৫ ও ১৬ নম্বরে আছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি নিখিল কুমার সাহা ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস হোসেন সোহেলের নাম। এ ছাড়া আছে খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি লাবু মোড়ল ও সাইফুল ইসলাম মানিকের নাম।
তালিকায় খুলনায় মাদকদ্রব্য প্রবেশের বিভিন্ন রুট এবং কেনা-বেচার স্থানগুলোর কথা তুলে ধরা হয়েছে। তালিকানুযায়ী, চোরাকারবারিরা সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা থেকে খুলনার চুকনগর অথবা আরেক সীমান্তবর্তী জেলা যশোর থেকে কেশবপুর হয়ে চুকনগর এবং অভয়নগর হয়ে ফুলতলায় বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য নিয়ে আসছে।
অন্যদিকে, যশোরের বেনাপোল থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেনকেও মাদক বহনের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাকারবারীরা। এদিকে, সাতক্ষীরা ও যশোর জেলাকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে ভারত থেকে ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য খুলনা শহরে নিয়ে আসা হচ্ছে।
এই চক্রের সদস্যরা সড়ক ও রেলপথ ব্যবহার করে সুকৌশলে নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিবহন করছে। শহরের জিরো পয়েন্ট ও খানজাহান আলী থানাধীন পথের বাজার এলাকা এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলেও তালিকায় উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া বেনাপোল থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেনে করে মাদকদ্রব্য দৌলতপুর ও খুলনা স্টেশনে পাচার হচ্ছে বলে জানা যায়। মাদক পাচারের কাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও তালিকায় জানানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন মালামালের সঙ্গে লুকিয়েও মাদক পাচার হচ্ছে।
এরপর বিভিন্ন স্তরের কারবারিদের হাত ঘুরে এসব মাদক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে প্রায় প্রতিদিনই মাদকদ্রব্যসহ ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। কিন্তু আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে তারা অনেকেই আবার একই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। খুলনা জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
এ ছাড়া খালিশপুর থানা এলাকায় ৪৪টি, খুলনা সদর থানা এলাকায় ১৪টি, খানজাহান আলী থানা এলাকায় ১৪ টি, লবণচরা থানা এলাকায় ১১টি, দৌলতপুর থানা এলাকায় ১০টি, আড়ংঘাটা থানা এলাকায় ৭টি, সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় ছয়টি এবং হরিণটানা থানা এলাকার তিনটি স্থানে মাদকদ্রব্য কেনা-বেচা হওয়ার তথ্য ওই তালিকায় উঠে এসেছে।
তেরখাদা উপজেলার সাতটি, দাকোপ উপজেলার নয়টি, পাইকগাছা উপজেলার চারটি, কয়রা উপজেলার দুইটি গ্রামে, বটিয়াঘাটা উপজেলার দুটি গ্রামসহ তৎসংলগ্ন এলাকায় মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হয়। তা ছাড়া, দিঘলিয়া উপজেলায় তিনটি এলাকায় এবং রূপসা উপজেলার তিনটি গ্রামসহ পাশের এলাকায় মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হয় বলে জানা যায়।
এ সব ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের খুলনার উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান জানান, মাদকদ্রব নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে লোকবল কম রয়েছে। তারপরও তালিকা অনুযায়ী নিয়মিত অভিযান চলছে। তবে তালিকায় সরকারি দলের নেতাকর্মীদের নাম আসায় সেভাবে অগ্রসর হতে পারছেন না তাঁরা। তালিকায় থাকা অনেক ব্যক্তি এরই মধ্যে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে তদবির শুরু করেছেন বলে জানান রাশেদুজ্জামান।