খুলনায় লাইসেন্স ছাড়াই চলেছ হাসপাতাল-ক্লিনিক

প্রকাশঃ ২০২১-০৮-০১ - ১৮:১৪

নিবন্ধনের আবেদন ওপর চলে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান

কামরুল হোসেন মনি : নগরীতে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায় চলছে অধিকাংশই বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টারগুলো। শুধু অনুমোদনের জন্য অনলাইনে আবেদন করে, আবার কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো কিছু না করেই বহালতবিয়তে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অনুমোদনহীন এসব হাসপাতালে চিকিৎসার নামে ব্যবসা, প্রতারণাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও পরবর্তীতে অদৃশ্যর কারণে আবারও পুনরায় চালু করেন। রমরমা ব্যবসার কারণে খুলনা শহর থেকে শুরু করে উপজেলাগুলোতেও এখন রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে।
খুলনা বিভাগ পরিচালক (স্বাস্থ্য) এর দপ্তরের পরিচালক ডা: জসিম উদ্দিন হাওলাদার গতকাল শনিবার রাতে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি অল্পকিছু দিন হলো এখানে যোগদান করেছি। কোভিড-১৯ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসলেই আমি নিজেই টিম নিয়ে নগরীতে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাবো। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ক্লিনিক বা ডায়াগণস্টিক সেন্টার শুধু অনুমোদনের জন্য অনলাইনে আবদেন করেই কেউ কোন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো চালাতো পারবেন না। এটা আইনগত ভাবে অপরাধ।
চলতি মাসে গত ১৬ জুলাই (শুক্রবার) রাতে নগরীতে সুন্দরবন ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টারে অবৈধ গর্ভপাত, নবজাতক বিক্রির ও পাচার চেস্টার অপরাধে ক্লিনিক মালিকসহ ১০ জনকে আটক করেছিলো র‌্যাব-৬।
প্রেসবিফিংয়ে র‌্যাব বলেছিলেন, মানব সেবার মত প্রশংসনীয় কাজে নিয়োজিত থেকে সুন্দরবন ক্লিনিক ব্যবসার আড়ালে অবৈধ বাচ্চা প্রসব, অবৈধ গর্ভপাত ও শিশু পাচারসহ বিভিন্ন ঘৃন্য কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। শুধু তাই নয় অবৈধ গর্ভপাত ও শিশু বিক্রির মতো নিকৃষ্ট কাজে রোগীদের উৎসাহিত করতো ক্লিনিকটির মালিক।
খুলনা সিভিল সার্জন অফিসের সূত্র অনুযায়ী, সরকারি নীতিমালায় একটি ১০ শয্যার ক্লিনিক পরিচালনায় ৩ জন এমবিবিএস ডাক্তার, ৬ জন ডিপ্লোমা নার্স, ৬ জন আয়া এবং ৩ জন সুইপার নিয়োগের বিধান রয়েছে। কিন্তু ক্লিনিক পরিচালনায় সরকারি নীতিমালা বিভিন্ন অজুহাতে মানছেন না অনেক প্রভাবশালী ক্লিনিক মালিক।
অভিযোগ রয়েছে, কোন তদারকি না থাকায় বছরে একবার স্বাস্থ্য বিভাগের পরিদর্শনের সময়ে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পার পেয়ে যায় নীতিমালা তোয়াক্কা না করা অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই। ২০২০ সালে নগরীর নার্গিস মেমোরিয়াল ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী সাদিয়া সোয়াইদা তাজিয়ার (১১) মৃত্যুর অভিযোগে ক্লিনিকটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় ক্লিনিকটির ব্যবস্থাপক ডা: কিউ আরিফ উদ্দিন আহমেদ, ডা: স ম জুলকার নাইন, ডা: মাফি, ডা: রানা, নার্স সুমি ও নার্স রাসনাকে আসামী করে মামলাও হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অজ্ঞাত কারণে আবারো ক্লিনিকটিতে চালুর অনুমতি দেওয়া হয়। একই সালে ১৬ জুলাই থেকে অনিবন্ধিত হাসপাতালে ক্লিনিকের বিরুদ্ধে নগরীতে অভিযান শুরু করেছিলো খুলনা জেলা প্রশাসন। অভিযানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্স না থাকা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও কাগজপত্র না থাকায় নগরীর খানজাহান আলী রোডের মীম নার্সিং হোম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তৎকালীন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইমরান খান ও সেটু কুমার বড়ুয়া জানান, ক্লিনিকটিতে কোনো সার্বক্ষণিক চিকিৎসক বা নার্স নেই। হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা (আয়া) নার্সের পোশাক পরে চিকিৎসা দেয়। চারপাশে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, অনেকটা গোডাউনের মতো। মেডিকেল প্রাকটিস এবং বেসরকারি ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরি (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর বিধি অনুযায়ী ৫ দিনের মধ্যে এখানে চিকিৎসাধীন রোগীদের অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
গত ১৬ জুলাই (শুক্রবার) রাতে নগরীতে সুন্দরবন ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টারে অবৈধ গর্ভপাত, নবজাতক বিক্রির ও পাচার চেস্টার অপরাধে ক্লিনিক মালিকসহ ১০ জনকে আটক করেছিলেন র‌্যাব-৬। পরেরদিন দুপুরে প্রেসব্রিফিংয়ে র‌্যাব-৬ অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল রওশনুল ফিরোজ বলেছিলেন, মানব সেবার মত প্রশংসনীয় কাজে নিয়োজিত থেকে সুন্দরবন ক্লিনিক ব্যবসার আড়ালে অবৈধ বাচ্চা প্রসব, অবৈধ গর্ভপাত ও শিশু পাচারসহ বিভিন্ন ঘৃন্য কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। শুধু তাই নয় অবৈধ গর্ভপাত ও শিশু বিক্রির মতো নিকৃষ্ট কাজে রোগীদের উৎসাহিত করতো ক্লিনিকটির মালিক। ওই ক্লিনিকে প্রায়শই অবৈধ বাচ্চা ক্রয় বিক্রয় ছাড়াও নানাবিধ অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পাশাপাশি মেয়াদ উর্ত্তীণ রেজিস্টেশনের সুন্দরবন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রেজিষ্টার্ড ডাক্তার কিংবা প্রশিক্ষিত নার্স কারো উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কথিত ডাক্তার মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট হয়েও রোগী দেখা থেকে শুরু করে সিজারিয়ান অপারেশনও পরিচালনা করতো। ক্লিনিকে ব্যবহৃত ওষুধ ও ব্যবহারের অযোগ্য সরঞ্জামাদি ক্লিনিকের পরিবেশকে অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। বসবাসের অযোগ্য এ পরিবেশে ক্লিনিকের মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট নিজেই বিভিন্ন সময় নানাবিধ সিজারিয়ান অপারেশনসহ বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে।
খুলনা বিভাগ পরিচালক (স্বাস্থ্য) অধিদপ্তরের সূত্র মতে, নগরীতে ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক মিলে মোট সংখ্যা রয়েছে ২১২টি। এর মধ্যে অনলাইনের মাধ্যমে ২০২০-২১ সালের নবায়ন করেছিলো মাত্র ৬৩টি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিকসেন্টারগুলো রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগণস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশন (বিপিএইচসিডিওএ) এর সভাপতি ডা: গাজী মিজানুর রহমান বলেন, সরকারি নিয়ম নীতি অনুসারী নগরীতে প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক এবং ডায়াগণস্টিকসেন্টারগুলো পরিচালিত হচ্ছে কি না সে বিষয়ে আমরা ২০২০ সালে সার্ভে করেছিলেন। ওই সময় নগরীর অনেক ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিকসেন্টারগুলো সরকারি নিয়ম তোয়াক্কা না করেই পরিচালনা করায় আমরা সেগুলো একটা তালিকা করেছিলাম। সেই তালিকাটা তৎকালীণ খুলনা বিভাগীয় স্বাস্খ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নগরীতে প্রাইভেট ক্লিনিক হাসপাতাল ও ডায়াগণস্টিনসেন্টাগুলোতে সঠিক মনিটরিং ও তদারকি না থাকায় অনেকেই অনিয়ম করেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। শুধু মাত্র অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করেই কেউ কোন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান চালাতে পারেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সূত্র মতে বেসরকারি একটি সংগঠন , ২০২০ সালে জুলাই মাসে ৩৬ ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিকসেন্টার বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগণস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশন (বিপিএইচসিডিওএ) এর সদস্য ও ট্রেডলাইসেন্স না পাওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মধ্যে রয়েছে মেঘনা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগণস্টিক সেন্টার, অনুসন্ধান ডায়াগণস্টিক এন্ড থাইরয়েড সেন্টার, বয়রা সেন্ট্রাল ডায়াগণস্টিক সেন্টার, ডা: আমান উল্লাহ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জি.এম.এইচ. মেমোরিয়াল হাসপাতাল, বয়রা সেন্ট্রাল ডায়াগনষ্টিক, মধুমতি ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, পপুলার ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, সৈকত এক্সওে, মাসুদা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, সাঊথ জোন (প্রা:) হাসপাতাল, ল্যাব এইড লিমিটেড (ডায়াগনষ্টিক), কমফোর্ট ডিজিটাল এন্ড কনসালট্যান্ট সেন্টার, এ্যাংকর ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন, আইকন হেলথ কেয়া, গ্রীন ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, বিসমিল্লাহ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, জনতা এক্সেওে, লিন্ডা ক্লিনিক, এম. কে. ল্যাব ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, ল্যাব কেয়ার ডায়াগনষ্টিক, নাজাত মেডিকেল কেয়ার এন্ড ডায়াগনষ্টিক, এ্যাপোলো ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, অপটিক ক্লিনিক, দেশ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, ল্যাবকন হেলথ কেয়ার, মোহম্মাদ ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার এবং আই প্যাভিলিয়ন এন্ড ফ্যাকো সেন্টার