কামরুল হোসেন মনি: মহানগরী খুলনার চাঁনমারী এলাকার বাসিন্দা মোঃ শরীফ (ছদ্মনাম)। তার প্রাইমারী স্কুল পড়ুয়া ছেলে সাব্বির (৯)। ছেলেকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত বাবা-মা। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা ছেলেটি যেন আগের মতো নেই। সন্ধ্যা পেরিয়ে বাসায় ফেরে। ছেলের এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ দীর্ঘদিন ধরে খোঁজ নিয়ে শরীফ যা জানতে পারেন, রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। ছেলে তার মাদকের মরণ নেশায় আসক্ত। প্রথমে সে ইয়াবা বহন করে এক জায়গায় পৌঁছে দিতো। এখন সে নিজেই ইয়াবা সেবনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ছেলেকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে দেওয়া হয় মাদকাসক্ত চিকিৎসা কেন্দ্রে।
খুলনা জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের অধীনে মহানগরীতে বেসরকারিভাবে ৬টি মাদকাসক্ত চিকিৎসা নিরাময় কেন্দ্রে রয়েছে। এর বাইরে সরকারিভাবে পরিচালিত হচ্ছে একটি। একাধিক মাদকসক্ত চিকিৎসা নিরাময় প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলে মাদকাসক্তদের মাদক গ্রহণের বিষয়ে নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। যারা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি রয়েছেন তার ৮০ শতাংশই ইয়াবা আসক্ত। বাকীরা অন্যান্য মাদক সেবনে আসক্ত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনায় প্রায় ৪০ হাজারের ওপরে মাদকাসক্ত রয়েছে। এর মধ্যে মহানগরীতে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। এখন নতুন করে ইয়াবা আসক্ত হচ্ছে প্রাইমারী স্কুল পড়–য়া ছাত্ররা। মাদকের বাজার ধরে রাখতে বিক্রেতারা এখন স্কুল-কলেজকে বেছে নিয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের স্কুলব্যাগে করে মাদক বহন ও বিক্রি করতে পারে। যে কারণে মাদক বিক্রেতাদের এখন প্রধান টার্গেট শিক্ষার্থীরা। মাদকের মধ্যে ইয়াবার সংখ্যা বেশি। এরপর রয়েছে ফেনসিডিল। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, চাকরিজীবী মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়েছেন। একাধিক মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে এ খবর জানা গেছে।
খুলনা জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় এর উপ-পরিচালক মোঃ রাশেদুজ্জামান বলেন, ইয়াবা বিক্রেতা ধরতে খুব বেগ পেতে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইয়াবা কাছে থাকার আলামত অভিযানে যাওয়ার আগেই ড্রেনে বাথরুমের ভেতর ফেলে দিচ্ছে। যার কারণে আলামত সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। অনেক ইয়াবা বিক্রেতা দোষ স্বীকার করায় তাদেরকেব ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে বেসরকারিভাবে ৬টি লাইসেন্সধারী মাদকাসক্ত নিরাময় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া ৩টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছেন। এছাড়া সরকারিভাবে পরিচালিত হচ্ছে একটি।
কেএমপি গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এ এম কামরুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের নজর এড়াতে মাদক বিক্রেতারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। আমাদের নগর ডিবির টিম দিন-রাত মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছেন।
নগরীর শিপইয়ার্ড সানমুন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, দিনকে দিন মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অভিভাবকরা মাদকাসক্ত ছেলেকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে এখানে চিকিৎসা করাচ্ছেন। তিনি বলেন, যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তার মধ্যে ৮০ শতাংশই ইয়াবা আসক্ত। চিকিৎসা নিতে আসা স্কুলছাত্র, কলেজছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ রয়েছে। যারা আসক্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যে নি¤œ ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা বেশি রয়েছেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নগরীর সোনাডাঙ্গাস্থ জামাই রাজু ওরফে মাস্টার, ছোট রাজু, আউলিয়া সাগর, হামিদা (পলাতক), সরোয়ার, থ্রি স্টার নামে পরিচিতি জাহানারা, হোসনেয়ারা ও লুতু। এদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ও ফেনসিডিল বিক্রি করে। এরা একাধিকবার আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। পরবর্তীতে জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় এ ব্যবসায় ফিরে যান। উল্লেখ্য, জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় ২০১৭ সালে ‘ক’ ও ‘খ’ এবং গোয়েন্দা বিভাগ মিলে ৯০৩টি অভিযান পরিচালনা করেন। যার মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় ৯২টি। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন মাদক থাকার অভিযোগে ২৮৫ জন মাদক বিক্রেতার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট ও নিয়মিত মামলা দায়ের করেন। যার মধ্যে নিয়মিত মামলার সংখ্যা রয়েছে ১৯৩টি। গত এক বছরে ইয়াবা ৭ হাজার ৭৫৮ পিস, ফেনসিডিল ৩১৪ বোতল, গাঁজা ২৮ কেজি ৭৫০ গ্রাম, বিয়ার ১৪ ক্যান, হেরোইন ১১ দশমিক ৫ গ্রাম, চোলাই মদসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করেন। এছাড়া মাদক বিক্রির ৪১ হাজার টাকা জব্দ করেন।