প্রাইভেট চেম্বারে ‘ফি’ নিয়ে রোগী দেখছেন সরকারি হাসপাতালে 

প্রকাশঃ ২০১৮-১২-১৫ - ২১:৩৮

 দালাল চক্রের সাথে চিকিৎসকদের সখ্যতা!

কামরুল হোসেন মনি : সালমা খাতুন (১৯)। গ্রাম থেকে বাবা-মায়ের সাথে শহরে আসার উদ্দেশ প্রাইভেট ক্লিনিকে ভালো গাইনী ডাক্তার দেখানো। সেই মোতাবেক নগরীর কেয়ার ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কসালটেশনে এসে গাইনী ডাক্তার ডাঃ ফারহানা হককে দেখানোর জন্য ৫শ টাকা ‘ফি’ও জমা দেন। কিন্তু তাকে প্রাইভেট চেম্বারে না দেখিয়ে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ওই ডাক্তারের চেম্বার দেখানো হয়। এ ঘটনায় রোগীর অভিভাবক প্রতিবাদ ও হট্টগোল শুরু করলে বিষয়টি উন্মোচন হয়। গত ১২ ডিসেম্বর খুলনা জেনারেল হাসপাতালে গাইনী বিভাগের গাইনী ও প্রসূতি ডাঃ ফারহানা হক এর চেম্বারে এ ঘটনা ঘটে।
সিভিল সার্জন ডাঃ এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভুক্তভোগী রোগীর অভিভাবক আমার কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। রোগীর কাছ থেকে যে ফি নেওয়া হয়েছে তা ফেরত দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ওই ডাক্তারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য না করে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
খুলনা জেনারেল হাসপাতালের গাইনী ডাঃ ফারহানা হক বলেন, কেয়ার ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ওই রোগীকে দেখছিলাম। বিষয়টি তো মীমাংসা হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোগীর টাকাও ফেরত দেওয়া হয়।
গত ১২ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে গাইনী বিভাগের সামনে সালমা খাতুনের পিতা মোঃ রফিক শেখ বলেন, ‘আমরা ভাই গ্রামের মানুষ’। ডাক্তাররা একটু ভালোভাবে মেয়েকে দেখবে এই আশায় মেয়েকে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে আসি। মেয়েকে নিয়ে ওই দিন সকালে নগরীর ৩০. শামসুর রহমান রোডস্থ কেয়ার ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন আসি। সেখানে একজন ব্যক্তি (খালিদ হাসান দিপু) গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফারহানা হক এর ভিজিটিং কার্ড দেখিয়ে বলেন ওনাকে দেখাতে হলে ৫শ টাকা ভিজিট দেওয়া লাগবে। সেই মোতাবেক ৫শ টাকাও দেই। আধা ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পর ওই ব্যক্তিটি বলেন, ডাক্তার এখন চেম্বারের আসতে পারবেন না। আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে ওনার আরেকটি চেম্বারে। তারা আমাদেরকে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আমার মেয়ে সালমাকে যখন ওই ডাঃ ফারহানা দেখছিলেন তখন আরও দুইটি রোগী সাথে নিয়ে ঢোকেন। আমি তখন এর প্রতিবাদ করি। আমি টাকা দিয়েই ডাক্তার দেখাচ্ছি কেন আমার মেয়ের সাথে অন্য রোগীকেও দেখবে। আমি সরকারিভাবে ৫ টাকার টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাতে আসিনি। হাসপাতালের সিভিল সার্জনের কাছে অভিযোগ দেই। পরে সিভিল সার্জনের নির্দেশে আমার টাকা ফেরত দেন। পরে বহির্বিভাগীয় থেকে টিকিট কেটে (যার টিকিট নং-৩৮৯২৭/১৪৭, সিরিয়াল নং-৯, রোগী সালমা) ওই ডাক্তারকে দেখানো হয়। কেয়ার ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কসালটেশন দালাল খালিদ হাসান দিপু ক্ষমা চেয়ে এ যাত্রায় বেঁচে যান।
জানা গেছে, খুলনার নামকরা সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপচে-পড়া ভিড় থাকলেও দেশের চিকিৎসাসেবা হয়ে পড়েছে চেম্বার নির্ভর। সরকারি হাসপাতালে যেসব ডাক্তার চাকরি করেন তাদের প্রায় ৯৮ ভাগই চেম্বার খুলে প্রাইভেট প্রাকটিস করেন। শুধু অর্থের লোভে কতিপয় ডাক্তার হাসপাতাল থেকে কৌশলে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে চেম্বারে রোগীদের চিকিৎসা দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের আয়ের প্রধান উৎসই হলো প্রাইভেট প্রাকটিস। ৯৮ শতাংশ চিকিৎসকই কোনো না কোনো ক্লিনিক কিংবা প্রাইভেট চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখেন। রোগী প্রতি ফিও নেন ৫শ থেকে এক হাজার টাকা। সরকারি হাসপাতালে তড়িঘড়ি রোগী দেখেই দৌড়ান প্রাইভেট চেম্বারে। সরকারি হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই দু’হাতে টাকা কামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন চিকিৎসকরা। শুধু রোগী দেখার ফি নয়, নির্ধারিত ল্যাবে পাঠানোয় টেস্টের কমিশন, নির্ধারিত কোম্পানির ওষুধ লেখায় ওষুধ কোম্পানির কমিশন এবং নানা ধরনের গিফট পান। ফলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যত দিনকে দিন চেম্বার নির্ভর হয়ে পড়েছে।
একজন চিকিৎসক সরকারি চাকরির পাশাপাশি নিজস্ব চেম্বারে বসেন। এমনকি একাধিক চেম্বারেও বসেন। চেম্বারে বসা অন্যায় না হলেও সরকারি চাকরিকে ব্যবহার করে চেম্বারে রোগী ভেড়াচ্ছেন। অধিকাংশ চিকিৎসকেরই ভিজিটিং কার্ডে চেম্বারের ঠিকানা উল্লেখ থাকে। একজন চিকিৎসক একাধিক চেম্বারও করে থাকেন।