বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি মাঝখানে
ইউনিক ডেস্ক : ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙন, লবনাক্ততাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে বসবাস করতে হয় খুলনা উপকূলীয় উপজেলা পাইকগাছা ও কয়রার মানুষের। যে দুই উপজেলা নিয়ে খুলনা-৬ আসন। কয়রার ৭টি ও পাইকগাছার ১০টি মোট ১৭টি ইউনিয়ন এবং পাইকগাছা পৌরসভা নিয়ে এই আসনের সীমানা। খুলনার ছয়টি আসনের মধ্যে ভোটার সংখ্যা সবচেয়ে বেশী এই আসনে। নির্বাচন এগিয়ে আসতেই সরব হয়ে উঠছে এলাকা। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা রয়েছেন এ আসনে। তবে সব দলের প্রার্থী থাকলেও বিগত নির্বাচনগুলোর মতো আগামী নির্বাচনেও এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগীতা হবে বলে সাধারণ ভোটারা মনে করছেন। তবে আটঘাট বেঁধে এই আসনে মাঠে রয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীও।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে এ আসনে প্রথম সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের এম এ বারী। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের খান-এ-সবুর, ৮৬ সালে জাতীয় পার্টির মোমিন উদ্দীন আহমেদ, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির জহুরুল হক সরদার, ১৯৯১ সালে জামায়াতের অধ্যক্ষ শাহ্ মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের এ্যাডভোকেট শেখ মোঃ নুরুল হক, ২০০১ সালে ৪ দলীয় জোট প্রার্থী জামায়াত নেতা অধ্যক্ষ শাহ্ মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের এ্যাডভোকেট সোহরাব আলী সানা, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের এ্যাডভোকেট শেখ মোঃ নূরুল হক বিনাভোটে এমপি নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয় লাভ করেন আওয়ামী লীগের আক্তারুজ্জামান বাবু। ১৪১টি কেন্দ্রে তিনি দুই লাখ ৮৪ হাজার ৩৪৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষের (জামায়াত) আবুল কালাম আজাদ পেয়েছিলেন মাত্র ১৯ হাজার ২৫৭ ভোট। গতবার নির্বাচনে আরও অংশ নিয়েছিলেন, জাতীয় পার্টির শফিকুল ইসলাম মধু, সিপিবির সুভাষ চন্দ্র সানা, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী নূর আহমাদ, বিএনএফ এর মির্জা গোলাম আজম ও জাকের পার্টির শেখ মর্তুজা আল মামুন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগে একাধিক নেতা গোপনে দৌড়াদৌড়ি করছেন। যার মধ্যে আছেন বর্তমান এমপি জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু, জেলার উর্ধতন সহ-সভাপতি সাবেক এমপি এ্যাডভোকেট সোহরাব আলী সানা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিকল্পনা উপ- কমিটির সদস্য, কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালিন সাধারণ সম্পাদক সানা ইউনুছুর রহমানের সন্তান সাইফুল্লাহ্ আল মামুন। জেলা যুবলীগের সাভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ কামরুজ্জামান জামাল, সাবেক এমপি মরহুম শেখ মোঃ নুরুল হকের পুত্র জেলা শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক শেখ রাশেদুল ইসলাম রাসেল, সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী প্রেম কুমার মন্ডল, কোষাধ্যক্ষ প্রকৌশলী জি এম মাহবুবুল আলম এবং স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডাঃ শেখ মোঃ শহীদুল্লাহ। এ ছাড়া আরও যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন, আনোয়ার ইকবাল মন্টু, কামরুল হাসান টিপু, মহাসিন রেজা, মুনসুর হাজী, আব্দুর রজ্জাক মলুঙ্গী। তবে সবাইকে ছাপিয়ে এ আসনে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা।
অপর দিকে বিএনপি থেকে প্রার্থী হতে পারেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মোঃ রফিকুল ইসলাম, পাইকগাছা উপজেলার আহবায়ক ডাঃ আব্দুল মজিদ, কয়রা উপজেলা সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট মোমরেজুল ইসলাম এবং জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মনিরুজ্জামান মন্টু। আর বিএনপি জোটের শরীক জামায়াত ইসলামীও এ আসনটি ধরে রাখতে প্রকাশ্যে কোন তৎপরতা না চালালেও কৌশলে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাইতো আগামী নির্বাচনেও বিএনপি জোটের প্রার্থী হতে চান জামায়াতের নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। অবশ্য বরাবরই এটি তাদের আসন বলেও মনে করেন তারা।
এছাড়া একক প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির জেলা শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মধু, সিপিবির কমরেড শেখ আব্দুল হান্নান ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা শাখার সেক্রেটারি হাফেজ আসাদুল্লাহ আল গালিব নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য ও পাইকগাছা উপজেলার আহবায়ক মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। জাতীয় সংসদের ১০৪ নম্বরের এই আসনে বর্তমান ভোটার (২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত তালিকা মোতাবেক) চার লাখ ৭ হাজার ৩৮৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ছয় হাজার ৬০৮ এবং নারী ভোটার দুই লাখ ৭৭৯ জন।
এলাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান এমপি আক্তারুজ্জামান সব সময় জনগণের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন। তবে বেড়িবাঁধ ভাঙ্গণের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরামত না করাসহ কিছু বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অপরদিকে সাবেক এমপি সোহরাব আলী সানাও এলাকায় খানিকটা আলোচিত। দলের একাংশের অভিযোগ, এর আগে সংসদ সদস্য থাকাকালে তিনি পরিবারতন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও জামাই নিয়োগ-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
এ বিষয়ে বর্তমান এমপি আক্তারুজ্জামান বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্য নয়। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হলে দৌড়ে পাশে গিয়ে দাড়িয়েছি, নিজে এলাকাবাসীর সাথে মাটি কেটেছি। আম্ফান, ইয়াস, বুলবুল, ফনি ও সিত্রাং নামের পাঁচটি ঘূর্ণিঝড় আমি এমপি থাকার সময়ে আঘাত হেনেছে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমি সব সময় তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা করেছি। আমার আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট ব্রীজসহ এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এছাড়া বেড়িবাঁধ উন্নয়নে সরকারের দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে। তাই তৃণমূলের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হলে দলীয় মনোনয়ন আমিই পাব, এটি আমার বিশ্বাস।
সাবেক এমপি সোহরাব আলী সানা বলেন, নিন্দুকেরা আমার নামে বিভিন্ন বদনাম দিয়েছে, যা সত্য নয়। আমি নির্বাচিত হয়ে কয়রা-পাইকগাছায় কোটি কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। সার্বক্ষণিকভাবে জনগণের কাতারে ছিলাম, আছি ও থাকবো। তাই একজন প্রবীণ দলের লোক হিসেবে আমি মনোনয়ন পেলে খুশি হবো। অবশ্য না পেলে অখুশি হবো না। সবসময় দলে মতামতেই কাজ করবো।
সাইফুল্লাহ আল মামুন জানান, তিনি সাবেক বিএল কলেজ ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক। এলাকায় কোন গ্রুপিং রাজনীতির সাথে জড়িত নেই। সকল গ্রুপের সাথেই রয়েছে তার সুসম্পর্ক। তিনি বলেন, এলাকার তরুণ সমাজকে সাথে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করে চলেছি। এবার নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন।
মোঃ কামরুজ্জামান জামাল জানান, আমি পূর্বেও মনোনয়ন চেয়েছিলাম এবারও চাইবো। দীর্ঘ দিন ধরে দলের হয়ে সরকারের উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত করছি। তাই আশা করছি আমাকে মনোনয়ন দিলে দলের জন্য ও এলাকার মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে পারবো।
অপরদিকে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শফিকুল ইসলাম মধু বলেন, এই এলাকার মানুষের সাথে দীর্ঘ কালের সম্পর্ক। তাদের সুখে দুঃখে সব সময় পাশে থাকি। তাই দলের মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হয়ে আর্থ সামজিক উন্নয়নে এলাকার আমূল পরিবর্তন করতে চাই। শফিকুল ইসলাম মধু আরও বলেন মহাজোটে নির্বাচন হলে এটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া উচিৎ। এবিষয়ে আগেও কথা হয়েছে।
এলাকার কয়েক জন বিএনপি নেতা জানালেন, আমরা এখনও বুঝতে পারছিনা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা। তাই আমরা এখন গণসংযোগের চেয়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে চলমান আন্দোলন বেগবান করছি। যদি নির্বাচনের পরিবেশ হয় তাহলে দলের অনেক ত্যাগী নেতা রয়েছে যারা প্রার্থী হতে চাইবেন। আছেন তরুণ নেতারও।