কামরুল হোসেন মনি : মোসাঃ আজমেরি। অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। তার পিতা পীর মোহাম্মদ। ২০ বছর আগে মারা গেছেন। বাবাহারা সংসারে একেবারেই কর্মহীন এবং বোঝা ছিল। অনেক দুঃখ ও কষ্টের স্মৃতি নিয়েই জীবন শুরু। ৪ বছর আগে ওব্যাট হেলপার্স এর প্রতিষ্ঠান থেকে বিনা খরচে সেলাই ও অ্যাম্ব্রয়ডারি কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন সংসারের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। ওই প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন নিজেই প্রশিক্ষক। ঘরে বসেই মাসে ৬-৭ হাজার টাকা আয় করছেন। তার মত হতদরিদ্র নানান বয়সের মেয়েদের আত্মনির্ভরশীলতার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের মাঝে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পথ দেখিয়ে যাচ্ছে ওব্যাট হেলপার্স। শুধু প্রশিক্ষণই নয়, বিনা খরচে সুবিধা বঞ্চিত হতদরিদ্র মানুষের ছেলে-মেয়েদের জন্য প্রি-স্কুল, প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, কোচিং সেন্টার চালু রয়েছে।
বুধবার বিকেলে নগরীর খালিশপুর ৩নং ক্যাম্পে অবস্থিত ওব্যাট হেলপার্স পরিচালিত আইটি সেন্টার, সেলাই ও অ্যাম্ব্রয়ডারি প্রশিক্ষণ সেন্টারে সরেজমিনে গেলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সাথে কথা বলে তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো তুলে ধরেন।
সানজিদা। বয়স ১৪। এবার জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে ওব্যাট হেলপার্স আইটি সেন্টারে বিনা খরচে ৪ মাসব্যাপী কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বাবা লাল বাবু। পেশায় রিক্সাচালক। সানজিদা দুই মাস যাবৎ এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এখন তিনি স্বপ্ন দেখেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং হওয়ার। শুধু সানিজাদই নয়, এখানে প্রশিক্ষণ নিতে আসা অনেক পরিবারের নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থা। এদের মধ্যে কারো পিতা স্কুলের নাইট গার্ড কেউ বা কবরস্থানে স্বল্প মজুরিতে চাকরি করেন।
কথা হয় ওই প্রতিষ্ঠানের আইটি সেন্টারের প্রশিক্ষক মোঃ গোলাম হাসনাইন। তিনি বলেন, ২০১২ সাল থেকে ওব্যাট হেলপার্স আইটি সেন্টারে ৪ মাসব্যাপী বিনা খরচে সুবিধা বঞ্চিত মানুষের ছেলে-মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেকেই সরকারি চাকরি পেয়েছেন কেউ বা নিজেই কম্পিউটার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সুবিধা বঞ্চিত হতদরিদ্র মানুষের ছেলে-মেয়ে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়েই এই প্রশিক্ষণ সেন্টার। বেলা ২টা থেকে বিকেল ৪টা এবং ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দুই শিফট ভাগ করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সেলাই শেখা ও অ্যাম্ব্রয়ডারির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি বলেন, ২০১২ সাল থেকেই এই পর্যন্ত আইটি সেকশনে ২৮১ জন, সেলাইতে ৭৫৩ জন ও অ্যাম্ব্রয়ডারিতে ৬৩ জনকে বিনা খরচে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে এদের হাতে সনদপত্র তুলে দেওয়া হয়।
ওব্যাট হেলপার্স প্রতিষ্ঠানের খুলনা বিভাগের পরিচালক মোঃ হুমায়ুন কবির বলেন, ওব্যাট হেলপার্সের সিও আনোয়ার খান আকমাল। তিনি আমেরিকা প্রবাসী। প্রথমে তিনি পারিবারিক সাহায্যে ও জাকাতের টাকা দিয়ে ২০০৫ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে সুবিধা বঞ্চিত হতদরিদ্র মানুষকে সাহায্য দিতে শুরু করেন। এর মধ্যে দুঃস্থ পরিবারের মাঝে চিকিৎসা খরচ, বিয়ের খরচ, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন তৈরি। এরপর শুরু হয় সুবিধা বঞ্চিত মানুষের ছেলেমেয়েদের বিনা খরচে পড়াশুনা করার। প্রথমে প্রি-স্কুল দিয়ে শুরু। তারপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে এখন প্রাইমারী স্কুল, হাইস্কুলের কোচিং সেন্টারে বিনা খরচে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করানো হচ্ছে।
মোঃ হুমায়ুন কবির বলেন, সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। শুধু খুলনাতেই এই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ নেই, ঢাকা, রংপুর, চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনা খরচে ল্যাট্রিন ও ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। এছাড়া ওব্যাট হেলপার্স প্রতিষ্ঠান থেকে এই পর্যন্ত ৮০টি সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য পথ প্রশস্ত করা এই স্লোগান নিয়ে ওব্যাট হেলপার্স এর পথ চলা শুরু। বর্তমানে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেই এই প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষক আবার কেউ বা নিজেই কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন।
তিনি বলেন, এখানে প্রশিক্ষণ নিতে আসা অনেক মেয়ের এক সময় কষ্টের জীবন ছিল। কেউ পিতা-মাতার সংসারে আবার কেউ বা স্বামীর সংসারে একেবারেই কর্মহীন এবং বোঝা ছিল। দারিদ্রতার কষাঘাতে পড়ে স্কুলের বারান্দায় যাওয়ার সুযোগও হয়ে ওঠেনি। অনেক দুঃখ ও কষ্টের স্মৃতি নিয়েই এদের জীবন শুরু। কিন্তু এখন তাদের চোখে মুখে ভবিষ্যৎ গড়ার সুন্দর স্বপ্ন। তারা সকলেই এখন সংসারের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠছে এবং সমাজের মাঝে অনুকরণীয় হয়ে উঠছে। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।