চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে সর্বনাশা পরকীয়ায় তছনছ হয়ে যাচ্ছে একেকটি সংসার। শুধু সংসার তছনছেই সীমাবদ্ধ নয়, কখনো কখনো স্বামীকে খুন-গুম করছেন স্ত্রী আবার কোথাও স্ত্রীকে করছেন স্বামী। মায়ের প্রেমিককে গলা কেটে হত্যা করছেন ছেলে আবার বিয়ে হওয়ায় প্রেমিকাকে খুন করছেন প্রেমিক। এই পরকীয়ার বলি হচ্ছেন আত্মীয়-স্বজনও। অনেকে আবার ক্ষোভে-অপমানে গলায় দড়ি দিচ্ছেন, কেউ আবার সবকিছু জেনেই সামাজিক মর্যদা আর সংসার টিকিয়ে রাখতে নীরব থাকছেন। এসবের মূলেই রয়েছে ‘পরকীয়া’ নামক এ সামাজিক ব্যাধি।
উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে দরিদ্র পরিবারেও আঘাত হানছে এই সর্বনাশা পরকীয়া। চট্টগ্রাম নগরীতে দিনে গড়ে সংসার ভাঙছে ২০টি। এর বিরাট একটিimageঅংশের নেপথ্যে রয়েছে পরকীয়া। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, মূলত ধর্মীয় শিক্ষার অভাব ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এমন ঘটছে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার এবং আকাশ সংস্কৃতিও এর জন্য দায়ী। অনৈতিক সম্পর্কের ফলে পরিবার ও সমাজে কলহ-বিরোধ বাড়ছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, পিতামাতার পরকীয়া সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সন্তানের মানসিক বিষন্নতা ও আগ্রাসী মনোভাবের জন্ম দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে দু’টো খুনের ঘটনার পেছনে পরকীয়াকে দায়ী করছে পুলিশ। গত শনিবার (২৮ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাগর পাড়ের ঝোপ থেকে অজ্ঞাত হিসেবে দিনমজুর ইব্রাহীমের লাশ উদ্ধার করে বন্দর থানা পুলিশ। এর আগের দিন ২৭ নভেম্বর রাতে মাছ কেনার কথা বলে সাগর পাড়ে নিয়ে পেছন থেকে ছুরি চালিয়ে গলা কেটে হত্যা করে রাখা হয় ইব্রাহীমকে। পরে সেই ছুরি সাগরে ফেলে নিরাপদে সটকে পড়নে এ খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সোহাগ ও রাসেল। যদিও শুক্রবার রাতে বন্দর থানার পুলিশ নোয়াখালীর সুর্বণচরের দুর্গম এলাকা থেকে অভিযুক্ত দু্ইজনকে গ্রেপ্তারের পর এ হত্যাকাণ্ডের রহস্যভেদ করেছে। হত্যাকাণ্ডের অংশ নেওয়া গ্রেপ্তার রাসেল শনিবার চট্টগ্রামের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন বিস্তারিত।
মূলত খালাতো ভাইয়ের প্রেমিকাকে ফুসলিয়ে বিয়ে করার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি সোহাগ ও তার খালাতো ভাই। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রামে এসে নিহত ইব্রাহীমের সাথে সখ্য গড়ে তোলেন সোহাগ। তারা চট্টগ্রামের বন্দর থানা এলাকায় একসাথে বিভিন্ন স্থানে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিশোধ নিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) রাতে সাগর পাড় থেকে ইলিশ মাছ কেনার কথা বলে সোহাগ, ইব্রাহিম (নিহত) ও রাসেল নামে অপরজনকে নিয়ে আনন্দবাজার সাগর পাড়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর কথা বলতে বলতে হত্যার জন্য ভাড়াটিয়া রাসেল পিছন থেকে ইব্রাহীমের গলায় ছুরি চালিয়ে দেন। এতে গলা কেটে দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান ইব্রাহীম।
একই দিনে কোতোয়ালী থানা পুলিশ নগরীর বকশিবিট এলাকা থেকে তিন দিন আগে হত্যা করে খাটের নিচে ফেলে রাখা অবস্থায় মাধব দেবনাথ (২৪) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে। সেই খুনের ঘটনায় নারীসহ ৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেছেন, নিহত স্বর্ণের কারিগর মাধব দেবনাথের সাথে স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল বলে সন্দেহ করতেন পিন্টু। এই সন্দেহ থেকে তাকে ২ ডিসেম্বর বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন পিন্টু। এরপর মাধবকে হত্যা করে তার বাসার খাটের নিচে ঢুকিয়ে রাখেন তিনি। তিন দিন পর লাশ পঁচে দুর্গন্ধ বের হলে পুলিশকে খবর দেয় স্থানীয় লোকজন। এরপর পুলিশ এসে আফিমের গলির ওই ভবন থেকে মাধবের লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় রাতে পিন্টুর বাসায় অভিযান চালিয়ে তার মা, বাবা, স্ত্রী ও দুই ভাইসহ মোট ৬ জন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ। শুধু এ দুটি নয় চট্টগ্রাম নগরে ও জেলায় পরকীয়ার কারণে প্রতিমাসে দু-তিনটা করে এরকম খুনের ঘটনা ঘটছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদনকারী অধিকাংশই নারী। দিনে গড়ে ২০টির মত আবেদন জমা পড়ে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। তবে এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পরকীয়ার জেরে সংসারে অশান্তি। ছেলেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, পর পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক, সংসারে মানিয়ে না চলা, স্বামীর কথা না শোনা। আর মেয়েদের বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক বা দ্বিতীয় বিয়ে, স্বামীর মাদকাসক্তি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রটে জাহানারা ফেরদৌস সিভয়েসকে বলেন, ‘নানা কারণে কমপক্ষে দৈনকি গড়ে ২০টির মত বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে। এরমধ্যে নানা অভিযোগের মধ্যে পরকীয়ার অভিযোগও রয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে পরকীয়ার অভিযোগটা প্রমাণিত করা কঠিন। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর দুজনের মতবিরোধ সন্দেহ তাদের সংসার ঠিকিয়ে রাখতে পারেনা।’
বাংলাদেশ ক্রিমিনোলজি অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন সিভয়েসকে বলেন, ‘পরকীয়া ও পরকীয়ার জেরে খুনের পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও প্রভাব রয়েছে। এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন আরেকজনকে কুৎচিত অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে, এক পর্যায়ে একজন আরেকজনের প্রতি কৌতুহলের সৃষ্টি হয়, শুরু হয় দ্বিতীয় প্রেম নামের পরকীয়া সম্পর্ক। অবাধে মেলামেশার কারণে, পারিবারিক বন্ধন মজবুত না হওয়ার ফলে মূলত এ পরকিয়ার সৃষ্টি হয়।’
একের পর এক কেন পরকীয়া এ ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. অনুপম সেন সিভয়েসকে বলেন, ‘এসব নতুন কিছু না, যোগযোগ ধরে ভালোবাসার জেরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে আসছে। আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ আফ্রিকা সবখানেই একই অবস্থা। ইউরোপে তো এ পরকীয়ার জন্য ট্রয়ের যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। হেলেন তার স্বামী তৎকালীন স্পার্টা নগরীর রাজা মেনেলাউসকে ছেড়ে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের সাথে ট্রয় নগরীতে পালিয়ে যান। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই মেনেলাউস যুদ্ধযাত্রা করে এবং ট্রয়ের যুদ্ধ সংঘঠিত হয়।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে এ সমাজ বিজ্ঞানী বলেন, ‘পরকীয়া এবং পরকীয়ার জেরে খুনের ঘটনা যে ঘটছে তা খুবই দুঃখজনক। এখান থেকে বের হতে হলে আমাদের পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে হবে। সামাজিক মুল্যবোধ ও নৈতিকতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।’