জাতীয় নির্বাচন : মনোনয়নে আওয়ামী লীগের গুরুত্ব তৃণমূল

প্রকাশঃ ২০২৩-০৪-০২ - ১০:৫০

# চ্যালেঞ্জে শতাধিক এমপি # চাপের মুখে সাংগঠনিক সম্পাদকরা # জেলার পর উপজেলা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক

ইউনিক ডেস্ক : বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শতাধিক এমপি মনোনয়ন চ্যালেঞ্জে রয়েছেন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, নিজস্ব বলয় তৈরি, এলাকায় সংগঠনকে দুর্বল করা, নারী কেলেঙ্কারি, পারিবারিক দ্বন্দ্বে সামাজিক মর্যাদাহানি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও, অডিওসহ কথোপকথনের রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ায় দলীয় এবং বিভিন্ন সংস্থার জরিপে তারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন।

এছাড়া বয়সের ভারে ন্যুব্জ প্রবীণ অনেক এমপি এবার মনোনয়নবঞ্চিত হতে পারেন। নতুন নেতৃত্ব দাঁড় করানোর লক্ষ্যে টানা তিনবারের অনেক এমপি বাদ পড়তে যাচ্ছেন। জেলা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের পর মনোনয়নের খসড়া করবেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসতে চায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এজন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি কাজ শুরু করেছে দলটি। এ লক্ষ্যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের পাশাপাশি চলছে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ।

দলীয় নেতারা জানান, আগামী নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জের। তাই সবদিক বিবেচনা করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাছাই করতে চায়। এ জন্য আমরা অনেক সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছি। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আমাদের এ নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সেসব অনুসরণ করছি।

জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট এলাকার সাংগঠনিক সম্পাদক এবং স্থানীয় এমপিদেরও ভাগ্য নির্ধারণ হতে পারে।

আসন্ন সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী করা নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, সামনের নির্বাচনটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। এই নির্বাচনে আমাদের ভোটেই বিজয়ী হতে হবে। এজন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাদের দিয়েও একটি জরিপ চালিয়েছেন। এতে অনেক নেতার বিরুদ্ধেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠে এসেছে। এসব অভিযোগে দলের পক্ষ থেকে পৌরসভাসহ উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, এমপি বলয়, বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান বা ইন্ধনে দলের অভ্যন্তরে কোন্দল সৃষ্টির বিষয়টি উঠে এসেছে। এমনকি অনেক এমপি-মন্ত্রীর নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার অবস্থাও নাজুক। জনবিচ্ছিন্ন হলেও এলাকায় তৈরি করেছেন নিজস্ব বলয়। এতে তৃণমূলের ত্যাগী-পরিশ্রমী, পরীক্ষিত, ও দুর্দিন-দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকা অনেক নেতা রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছেন।

দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা বলেন, একাধিক সংস্থাকে দিয়ে মাঠজরিপ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমলনামা নিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে। তিনি দল বা নির্বাচন সবকিছুই বিচক্ষণতার সঙ্গে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেন। ফলে আগামী নির্বাচনে বিতর্কিত নয়, সৎ, শিক্ষিত, মেধাবী, ত্যাগী, পরীক্ষিত ও গ্রহণযোগ্যরাই দলীয় মনোনয়ন পাবেন। যত বড় নেতাই হোন, কাউকে ছাড় দেবেন না তিনি।

গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ৮ বিভাগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিমের নেতারা শেখ হাসিনার হাতে দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের ফিরিস্তি তুলে দেন। এর ওপর ভিত্তি করেও অনেক ডাকসাইটে নেতা দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হবেন। তাদের মধ্যে দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা এবং এমপি-মন্ত্রীও রয়েছেন। ফলে দলের সভাপতির চূড়ান্ত করা ২০০ জন এমপির বাইরে ১০০ আসনে প্রার্থিতায় পরিবর্তন আসতে পারে। এতে অনেকেরই এমপি হওয়ার ‘আশার গুড়ে বালি’ পড়বে।

সূত্রমতে, গত ১২ জানুয়ারি রাতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা মনোনয়ন নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। তিনি সব এমপিকে খোলাখুলিভাবে জানিয়েছেন কারা আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাবেন আর কারা পাবেন না।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানায়, দলীয়প্রধান আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় এমপিদের সতর্কতামূলক বার্তা দিয়েছেন। আগামী নির্বাচন কঠিন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে জানিয়ে কারো নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি কারো দায়িত্ব নিতে পারব না। মাঠজরিপের ভিত্তিতেই মনোনয়ন দেয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, যাদের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে এবং যে বিষয়ে অভিযোগ সেসব কিছুর ওপর একটি সার্ভে চলছে। বারবার মাঠজরিপ করে আমলনামা নেয়া হচ্ছে। সেই আমলনামা অনুসারে কোনো নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে কেউ রেহাই পাবে না।

মুখ দেখে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হবে না : এদিকে সাংগঠনিক সম্পাদকদের জরিপ রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর উষ্মা প্রকাশ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, সাংগঠনিক সম্পাদকরা জরিপ রিপোর্ট তৈরির সময় নিজস্ব বলয়ের দোষত্রুটি গোপন করেছেন। এজন্য সাংগঠনিক জরিপের পাশাপাশি বিশেষ সংস্থার সহযোগিতা নিয়েও দলীয় প্রার্থীদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, প্রথমে বর্তমান এমপিদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ। দ্বিতীয় ধাপে বিতর্কিত এমপিদের আসনে সম্ভাবনাময় নতুন প্রার্থীর প্রস্তাবনা। নতুন প্রার্থীকে দল এবং জনতা উভয়ের কাছেই আস্থাশীল হতে হবে।

সূত্রমতে, জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকের পর উপজেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার গণভবনে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা জেলা-মহানগর, নেত্রকোনা, নোয়াখালী, বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

বৈঠকে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন হবে অনেক চ্যালেঞ্জিং। মুখ দেখে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হবে না। যাদের জনপ্রিয়তা আছে, নেতাকর্মীদের নিয়ে চলেন তাদেরই মনোনয়ন দেয়া হবে। এমপি বা মেয়র থাকলেই যে মনোনয়ন দেয়া হবে তা ভাবার সুযোগ নেই। জরিপের ভিত্তিতেই আগামীতে মনোনয়ন দেয়া হবে।

সূত্র জানায়, দলীয় এবং দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জরিপের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন ঘোষণার আগ পর্যন্ত তা চলবে। ইতোমধ্যে প্রাপ্ত জরিপের ভিত্তিতে অর্ধশতাধিক এমপি মনোনয়ন বঞ্চিত হবেন। কারণ এসব এমপি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের পাশাপাশি তাদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় দলকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করে রেখেছেন। হাইকমান্ড একাধিকবার সতর্ক করলেও তারা না শুধরে নিজেদের মতো করেই দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে সব রিপোর্ট সমন্বয় করে নৌকার মনোনয়ন দেয়া হবে।

সর্বশেষ জরিপের তথ্যমতে, ৩০০ আসনের মধ্যে ৭৩টি আসন আওয়ামী লীগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে আবার চরম ঝুঁকির মধ্যে আছে ৩৯টি আসন। বাকি ৩৪টি আসন তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে আছে। এসব আসনের এমপিরা সাংগঠনিক কাজে মনোযোগ দেননি। উল্টো অভ্যন্তরীণ গ্রুপ তৈরি করে সংগঠনকে দুর্বল করেছেন। এছাড়া স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তৃণমূল নেতাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। প্রার্থী পরিবর্তন করলে এসব আসনের জয় নিশ্চিত হতে পারে বলে জরিপে উঠে এসেছে। এছাড়া জরিপে দেখা গেছে, আগামী নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হলেও ৯২টি আসনে আওয়ামী লীগের জয় সুনিশ্চিত। কোনোভাবেই এ সমস্ত আসনে আওয়ামী লীগের জয় ঠেকানো সম্ভব হবে না।

আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের প্রস্তুতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেন, ধারাবাহিকভাবে ৬৪টি জেলার নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক করছেন। এরপর তিনি উপজেলা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনছেন এবং নোট নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতাদের শৃঙ্খলা রক্ষার নির্দেশনা দিয়েছেন। সবাইকে সতর্ক করে তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। আগামী নির্বাচনের মাঠ প্রস্তুত করতে তিনি এমপিদেরকে স্থানীয় নেতাদের নিয়ে জনগণের কাছে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড প্রচারের নির্দেশনা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, দলীয় জরিপের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সংস্থার জরিপের ফলাফলের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা নেতাদের মতামত মিলিয়ে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন চূড়ান্ত করবেন।